হাওজা নিউজ এজেন্সি: কুরআনুল কারিম ও হাদীসের আলোকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন প্রজ্ঞার ভিত্তিতে আচরণ করেন। সৎ ও ঈমানদার মানুষ যদি কোনো ভুল করে, আল্লাহ দ্রুতই তাকে সতর্ক করেন, যেন সে সংশোধনের সুযোগ পায়। কিন্তু যারা পাপাচার, অন্যায় ও জুলুমে গভীরভাবে নিমজ্জিত, তাদের আল্লাহ অবকাশ দেন—একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। কারণ তাদের পূর্ণ ও চূড়ান্ত বিচার সংরক্ষিত থাকে কিয়ামতের মহাদিনের জন্য।
আল্লাহর ন্যায়বিচার দেরিতে হলেও নিশ্চিত
 আল্লাহর ন্যায়বিচার কখনো বিলম্বিত হতে পারে, কিন্তু তা কখনোই বিলুপ্ত হয় না। কুরআনে বলা হয়েছে: “তুমি মনে করো না যে আল্লাহ জালিমদের কাজকর্ম থেকে গাফেল। তিনি শুধু তাদেরকে এক নির্দিষ্ট দিনের জন্য অবকাশ দেন, যেদিন চোখগুলো আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে যাবে।” [সূরা ইবরাহীম: ৪২]
অর্থাৎ, আল্লাহ তৎক্ষণাৎ শাস্তি না দিলেও, তাঁর ন্যায়বিচার অমোঘ ও অবধারিত। দুনিয়ার স্বল্পকালীন আরাম বা কষ্ট—কোনোটিই আল্লাহর সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টির নিদর্শন নয়। বরং তা হতে পারে একটি পরীক্ষা, একটি সতর্কবার্তা, অথবা একটি অবকাশ।
আলেমে দ্বীনের বিশ্লেষণ
 ইরানের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ও কুরআনের বিশিষ্ট মুফাসসির হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন হুজ্জাতুল্লাহ কারআতী (আল্লাহ তাঁকে হেফাজত করুন) সম্প্রতি এক বক্তৃতায় “যুবসমাজের মনে উদ্ভূত প্রশ্ন: কেন দুনিয়ায় জালিমদের তৎক্ষণাৎ শাস্তি দেওয়া হয় না?”—এই প্রসঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা প্রদান করেন।
তিনি বলেন, “অনেক তরুণের মনে প্রশ্ন জাগে—যদি বলা হয়, মানুষ গোনাহ করলে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে কেন কিছু ধর্মহীন দেশেও মানুষ সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে থাকে, প্রচুর বৃষ্টি হয়? আবার অনেকে বলে, অন্যায় করলে তার ফল ভোগ করতে হয়, কিন্তু দেখা যায়, কেউ কেউ আরও বড় অন্যায় করেও বিলাসী জীবন যাপন করছে।”
শিক্ষণীয় উপমা
 এই জটিল প্রশ্নের উত্তর বোঝাতে হুজ্জাতুল্লাহ কারআতী একটি সহজ অথচ গভীর উদাহরণ দেন। তিনি বলেন, “ধরা যাক, এক ফোঁটা চা যদি চশমায় পড়ে, আমরা সঙ্গে সঙ্গে তা মুছে ফেলি। কিন্তু একই ফোঁটা যদি সাদা জামায় পড়ে, তখন তা সতর্কতার সঙ্গে পরিষ্কার করতে কিছুটা সময় নিই। আর যদি সেটা কার্পেটে পড়ে যায়, আর কিছুই করার থাকে না— শুধু পরিণতি মেনে নিতে হয় (অর্থাৎ কার্পেটটি অর্ধ-বাৎসরিক/বাৎসরিক ধৌতকরণের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়)।”
তিনি ব্যাখ্যা করেন, “ঠিক তেমনি আল্লাহ তায়ালার ব্যবস্থাপনাতেও প্রজ্ঞা ও ধৈর্যের স্তর আছে। একজন মুমিন যদি সামান্য ভুল করে, আল্লাহ রোগ, বিপদ বা অনুশোচনার মাধ্যমে দ্রুতই তাকে সতর্ক করেন। কিন্তু যে ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে পাপে নিমজ্জিত, জুলুমে অভ্যস্ত, তাকে আল্লাহ অবকাশ দেন— যেন সে নিজেই নিজের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। আর তার হিসাব চূড়ান্তভাবে কিয়ামতের দিনে নেয়া হবে।”
দুনিয়াবি অবস্থাই আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রমাণ নয়
 এই ব্যাখ্যা থেকে স্পষ্ট—দুনিয়ায় কারও ধন-সম্পদ, ক্ষমতা বা আরাম-আয়েশকে দেখে তার আল্লাহর নিকটবর্তীতা নির্ধারণ করা ভুল। আল্লাহ অনেক সময় জালিমদেরকে সময় ও সুযোগ দেন—যাতে তারা নিজেদের কর্মে পূর্ণতা লাভ করে এবং পরিণামে পূর্ণাঙ্গ শাস্তির যোগ্য হয়। অন্যদিকে, মুমিনদের ত্বরিত সতর্ক করা হয়—যাতে তারা সংশোধিত হয়ে আল্লাহর রহমত অর্জন করতে পারে।
কিয়ামতের ন্যায়বিচারই চূড়ান্ত সত্য
 কুরআন বহু জায়গায় ঘোষণা করেছে যে, এই দুনিয়া ন্যায়বিচারের পূর্ণ মঞ্চ নয়, বরং এটি একটি পরীক্ষা। চূড়ান্ত বিচার ও প্রতিদান কেবল কিয়ামতের দিনেই হবে। সেদিন কারও ছোট্ট সৎকর্মও উপেক্ষিত হবে না, আর কোনো অন্যায়ও অদণ্ডিত থাকবে না।
“যে পরিমাণ অণু পরিমাণ ভালো কাজ করবে, সে তা দেখতে পাবে; এবং যে অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করবে, সেও তা দেখতে পাবে।” [সূরা যিলযাল: ৭–৮]
অতএব, দুনিয়ায় জালিমদের তাৎক্ষণিক শাস্তি না পাওয়া আল্লাহর উদাসীনতা নয়, বরং তাঁর গভীর প্রজ্ঞা ও ন্যায়বিচারের অংশ। তিনি কাউকে অবকাশ দেন, পরীক্ষা করেন, সতর্ক করেন—কিন্তু কখনোই ভুলে যান না। আল্লাহর বিচার দেরিতে হতে পারে, তবে তা অনিবার্য—এবং সম্পূর্ণ ন্যায়ের ভিত্তিতেই সম্পন্ন হবে।
 “নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক সর্বদা নজর রাখছেন।”
 [সূরা আল-ফজর: ১৪]
            
                
আপনার কমেন্ট