সোমবার ৩ নভেম্বর ২০২৫ - ১৬:৩৪
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ কোনো কৌশলগত বিষয় নয়; এটি মূলগত ও আদর্শগত 

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বলেছেন, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ কোনো সাময়িক বা কৌশলগত বিষয় নয়; এটি মূলগত—নীতি ও আদর্শভিত্তিক—এবং দুই বিপরীত ধারার স্বার্থসংঘাতের প্রতিফলন।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ১৩ আবান ইরানের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ও গৌরবময় দিন। এই দিনটি “ছাত্র দিবস” এবং “বিশ্ব-অহংকারবিরোধী সংগ্রামের জাতীয় দিবস” হিসেবে পালিত হয়। এই দিনে, ১৩৫৮ হিজরী সালের ১৩ আবান (৪ নভেম্বর ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে), ইরানি ছাত্ররা যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন দূতাবাস দখল করে, যা পরবর্তীতে “লানে জাসুসি” বা গুপ্তচর নীড় নামে পরিচিত হয়।
এই ঐতিহাসিক দিনের প্রাক্কালে, হাজার হাজার শিক্ষার্থী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এবং সাম্প্রতিক যুদ্ধের শহীদ পরিবারগুলোর সদস্যরা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রুতা
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ি বলেন, “আমেরিকার সঙ্গে ইরানের বিরোধ আজকের নয়; এটি একটি দীর্ঘ ইতিহাসবহুল শত্রুতা, যার সূচনা হয়েছে ২৮ মরদাদ ১৩৩২ (১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ) সালের অভ্যুত্থান থেকে।”

তিনি স্মরণ করান যে, ব্রিটেন ও আমেরিকা একসঙ্গে ষড়যন্ত্র করে জাতীয়তাবাদী নেতা ড. মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের সরকারকে উৎখাত করে এবং পালিয়ে যাওয়া শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভীকে ক্ষমতায় পুনর্বহাল করে।

তিনি বলেন, “মোসাদ্দেক আমেরিকার কাছে ইংরেজদের হাত থেকে বাঁচার আশায় সাহায্য চেয়েছিলেন, কিন্তু আমেরিকা তার পেছনেই ছুরি মেরেছিল। সেই দিনই ইরানের জনগণ আমেরিকার প্রকৃত মুখ চিনে নেয়।”

এর পরবর্তী ২৫ বছর যুক্তরাষ্ট্র শাহের একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন করে, দেশের সম্পদ লুটে নেয় এবং ইরানি জনগণের উপর দমন-পীড়ন চালাতে তাকে সহায়তা দেয়।

আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ি বলেন, ইসলামী বিপ্লব ছিল এই নির্যাতন ও বিদেশি আধিপত্যের বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের ফল। কিন্তু বিপ্লবের পরও যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুতা বন্ধ হয়নি; তারা নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকেছে, সাদ্দামকে যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করেছে, নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, ইরানি যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করেছে এবং বহু উপায়ে জনগণের ক্ষতি সাধন করেছে।

*১৩ আবান ১৩৫৮— গুপ্তচর নীড় দখলের তাৎপর্য*
 আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ি বলেন, ১৩ আবানের ঘটনাটি প্রথমে শিক্ষার্থীদের সীমিত প্রতিবাদ হিসেবেই শুরু হয়েছিল। তারা শাহকে আশ্রয় দেওয়ার আমেরিকার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জাতির ক্ষোভ বিশ্বে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু দূতাবাসে প্রবেশের পর তারা আবিষ্কার করে— সেখানে এমন অসংখ্য গোপন নথি রয়েছে যা প্রমাণ করে যে, এই দূতাবাস কেবল কূটনৈতিক কার্যালয় নয়, বরং ইসলামী বিপ্লব ধ্বংসের ষড়যন্ত্রকেন্দ্র। সেখানে সাবেক রাজতান্ত্রিক ব্যক্তিদের, কিছু সামরিক কর্মকর্তাকে এবং বিপ্লববিরোধীদের সংগঠিত করার পরিকল্পনা চলছিল।

এই নথিগুলো প্রকাশের পর বিশ্ব জানতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে ইরানের বিপ্লবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।

আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ি বলেন, “১৩ আবান আমাদের জন্য গৌরব ও বিজয়ের দিন, কারণ সেই দিনেই যুক্তরাষ্ট্রের আসল চরিত্র উদ্ঘাটিত হয় এবং ইসলামী বিপ্লবের প্রকৃত পরিচয়ও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।”

 বিশ্ব-অহংকারবাদের প্রকৃতি
তিনি কোরআনের আলোকে “استکبار” শব্দটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, “‘استکبار’ মানে আত্মগরিমা বা নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবা। কেউ যদি কেবল নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে কিন্তু অন্যের অধিকার লঙ্ঘন না করে, তাতে শত্রুতা হয় না। কিন্তু যখন কেউ অন্য জাতির সম্পদে হস্তক্ষেপ করে, তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে চায়, অথবা তাদের ভূখণ্ডে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে— তখনই সে প্রকৃত অর্থে ‘মুতাকাব্বির’ বা অহংকারী হয়ে ওঠে। এইরকম আচরণই সেই استکبار, যার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করছি।”

তিনি বলেন, এক সময় ইংল্যান্ড এমন আচরণ করেছিল; আজ আমেরিকা করছে। এই অহংকারই হলো আমাদের ও তাদের বিরোধের মূল কারণ।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের মৌলিক বিরোধ
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ি বলেন, “ইরান ও আমেরিকার বিরোধ কোনো কৌশলগত বা অস্থায়ী মতভেদ নয়, বরং এটি মৌলিক ও নীতিগত। দুই বিপরীত প্রবাহ— একদিকে আধিপত্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে স্বাধীনতাপ্রিয় ইসলামী প্রজাতন্ত্র— এর স্বার্থ ও আদর্শ একে অপরের বিপরীতে অবস্থান করছে।”

তিনি বলেন, আমেরিকা এমন কোনো জাতিকে সহ্য করতে পারে না, যারা তার আধিপত্য মেনে নিতে অস্বীকার করে। তাদের প্রকৃতি হলো, তারা কেবল আত্মসমর্পণকেই সহযোগিতা মনে করে।

তিনি আরও বলেন, “আমাদের মতো ইতিহাসসমৃদ্ধ, চিন্তাশীল, সম্পদশালী এবং উদ্যমী তরুণ প্রজন্মের জাতি থেকে আত্মসমর্পণের প্রত্যাশা করা অর্থহীন।”
শক্তিশালী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ি বলেন, দেশের বিভিন্ন সমস্যা ও বিপদ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো শক্তিশালী হওয়া।
এই শক্তি হতে হবে—
•    প্রশাসনিক দক্ষতায়,
•    বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তিতে,
•    সামরিক প্রস্তুতিতে,
•    এবং আত্মিক বিশ্বাস ও প্রেরণায়।

তিনি বলেন, “যদি শত্রু বুঝে যে এই জাতির সঙ্গে সংঘাতে তার ক্ষতি বেশি এবং কোনো লাভ নেই, তখনই দেশ প্রকৃত নিরাপত্তা পাবে।”

তিনি গর্বের সঙ্গে বলেন, “আমাদের সামরিক বাহিনী আল্লাহর অনুগ্রহে দিন দিন  অগ্রগতি করছে, এবং এই অগ্রগতি আরও বাড়বে, যাতে বিশ্ব জানে— ইরান একটি শক্তিশালী জাতি, যাকে কোনো শক্তি নত করতে পারবে না।”

আমেরিকার সহযোগিতা প্রস্তাব সম্পর্কে
তিনি বলেন, “ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ কোনো সাময়িক বা কৌশলগত বিষয় নয়; এটি মূলগত (নীতি ও আদর্শগত) এবং দুই বিপরীত ধারার স্বার্থসংঘাতের প্রতিফলন।

তিনি জোর দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই ইরানের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চায়, তবে তাকে প্রথমেই অভিশপ্ত ও অবৈধ জায়নবাদী শাসন—ইসরায়েলের প্রতি সকল প্রকার পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। তাছাড়া, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে তাদের সব সামরিক ঘাঁটি সরিয়ে নিতে হবে এবং এ অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, “এই শর্তগুলো পূরণ হলে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রস্তাব বর্তমান সময় বা নিকট ভবিষ্যতে নয়, বরং দূর ভবিষ্যতে বিবেচনার উপযুক্ত হতে পারে।”

তরুণ প্রজন্মের প্রতি আহ্বান
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ি তরুণদের উদ্দেশে বলেন,
– দেশের ইতিহাস ও রাজনীতির বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করো;
– ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা করো;
– দেশের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে কখনো মন্থর হতে দিও না;
– বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পূর্বের মতো উদ্যম ফিরিয়ে আনো।

তিনি বলেন, “যুবক যদি আত্মিকভাবে দৃঢ় না হয়, ঈমান ও আল্লাহর উপর নির্ভরশীল না হয়, তবে সে প্রকৃত অর্থে ‘মৃত্যু হোক আমেরিকার’ বলতে পারবে না। প্রকৃত শক্তি নিহিত রয়েছে অন্তরের বিশ্বাসে।”

তিনি পরামর্শ দেন,
– প্রতিদিন কোরআন পাঠে অভ্যস্ত হও,
– নামাজে মনোযোগ দাও,
– হিজাব ও শালীনতাকে ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করো,
– হযরত ফাতিমা (সা.) ও হযরত জয়নাব (সা.)-এর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো,
– নিজের চারপাশের মানুষদেরকেও এই মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করো।

শেষে তিনি বলেন,
“যুব সমাজ যদি বিশ্বাস, জ্ঞান ও প্রেরণায় দৃঢ় থাকে, তাহলে দেশের অগ্রগতি কখনো থামবে না, আর কোনো শক্তিই ইরানকে পরাভূত করতে পারবে না।”

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha