রবিবার ৯ নভেম্বর ২০২৫ - ১১:০১
হযরত মুহসিন‌ বিন‌ আলী (আ.)-এর শাহাদাত: বাস্তবতা না কল্পকাহিনি?

ফাতিমিয়্যার দিনগুলোতে হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর রাজনৈতিক, সামাজিক ও সংগ্রামী সীরাতের আলোকে তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি বিশেষভাবে আলোচিত হয়। ইসলামের প্রারম্ভিক যুগে সংঘটিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে অন্যতম হলো গৃহে হামলা এবং এর পরিণতিতে হযরত মুহসিন (আ.)-এর সেকত (গর্ভপাত) হওয়া ও শাহাদাত। এই প্রবন্ধে নির্ভরযোগ্য শিয়া ও সুন্নি ঐতিহাসিক গ্রন্থ, রেওয়ায়াত ও বিশ্লেষণের আলোকে হযরত মুহসিন (আ.)-এর শাহাদাতের সত্যতা, প্রেক্ষাপট, উৎসসমূহ এবং কালান্তকালের ইমাম (আ.)-এর যুগে তাঁর পরিচয় সংক্রান্ত রেওয়ায়াতসমূহ উপস্থাপন করা হয়েছে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, তৃতীয় ও প্রধান হামলা— যা শেষ পর্যন্ত হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর শাহাদাতের কারণে উপনীত হয়—এটি সংঘটিত হয় উমর ইবন খাত্তাবের নেতৃত্বে, যখন তিনি ও একদল হামলাকারী হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর গৃহদ্বারে সমবেত হন। এই বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ আল্লামা মাজলিসি, শাহরেস্তানী, ইবনে মাসউদী, ইবনে আবিল হাদীদসহ বহু ঐতিহাসিক সূত্রে পাওয়া যায়।

প্রাথমিক ঐতিহাসিক দলিল ও ঘটনাবলির বর্ণনা

১. আল্লামা মাজলিসির বর্ণনা: আল্লামা মাজলিসি উল্লেখ করেন, “উমর ইবনে খাত্তাব তার একদল সহচর নিয়ে আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.)-এর বাড়িতে এল এবং তাঁকে (ঘর থেকে) বের হওয়ার আহ্বান জানাল। কিন্তু তিনি বের হতে অস্বীকৃতি জানালে উমর ইবনে খাত্তাব আগুন ও জ্বালানি আনতে নির্দেশ দিল!”

[বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ২৮, পৃ. ২০৪]

ঘরবাসী ছিল মাত্র চারজন—আলী (আ.), ফাতিমা (সা.), হাসান (আ.) ও হুসাইন (আ.)।

২. শাহরেস্তানীর বিবরণ
শাহরেস্তানী লিখেছেন, “সেদিন ঘরে তাঁদের (আলী (আ.), ফাতিমা (সা.), হাসান (আ.) ও হুসাইন (আ.) ছাড়া আর কেউ ছিল না!”
[আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, খণ্ড ১, পৃ. ৭১]

৩. অনুপ্রবেশ ও হামলার বিবরণ
পরিস্থিতি বিবেচনায় আমিরুল মু'মিনিন ইমাম আলী (আ.) ঘর থেকে বাইরে আসতে অস্বীকৃতি জানালে উমর ইবনে খাত্তাব হুমকি দিলেন, “আল্লাহর কসম! আমি আগুন প্রজ্বলিত করব!”

হযরত ফাতিমা (সা.) দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে উমরের সাথে সংলাপে বলেন,

“আমি আমার জীবনে এমন কোনো জাতিকে দেখিনি, যারা তোমাদের মতো এত বেইমান ও অনুভূতিহীন! তোমরা রাসূলুল্লাহর (সা.) জানাজা আমাদের ওপর ফেলে ফেলে রেখে খিলাফতের পিছনে ছুটেছ; আমাদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করোনি, আমাদের কোনো অধিকার মানোনি;

মনে হয়, তোমরা গাদিরে খুম দিবসে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ঘোষণা সম্পর্কে মোটেই অবহিত নও! আল্লাহর কসম! সেদিন তিনি এমনভাবে নেতৃত্বের বিষয়টি দৃঢ় করেছিলেন যে তোমাদের কোনো লোভ বা আশা রাখার স্থান ছিল না!
কিন্তু তোমরা তা রক্ষা করোনি এবং নবীর সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করলে!
অবশ্যই আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের মাঝে বিচার করবেন!”

[বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ২৮, পৃ. ২০৪]

এরপরও ওমর ইবনে খাত্তাব ও তার সহচররা গৃহদ্বার পুড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) প্রতিরোধ করলে ওমর ইবনে খাত্তাব তরবারির খাপ দিয়ে তাঁর পাঁজরে আঘাত করেন।

৩. হযরত মুহসিন (আ.)-এর সেকত (গর্ভপাত) হওয়া: ঐতিহাসিক উৎসসমূহ

৩.১ ইস্‌বাতুল ওসিয়্যাহ (আলী ইবন হুসাইন মাসউদী)
গ্রন্থটির ১৪৬ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে: “তারা (সদর) দরজা পুড়িয়ে গৃহে হামলা চালায়; আলী (আ.)-কে জোর করে বাইরে বের করে; ফাতিমা (সা.আ.)-কে দরজার পিছনে চেপে ধরে; এবং (এতে) মুহসিন সেকত (গর্ভপাত) হয়!”

৩.২ আল-ইখতেসাস (ইমাম সাদিক আ.)
এ গ্রন্থে ফাতিমার ফাদাক-বিরোধী প্রতিবাদের প্রসঙ্গে ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। তবে কিছু ঐতিহাসিক দলিলে এটি সরাসরি “গৃহে হামলার দিন”-এর ঘটনাকেই নির্দেশ করে।

৩.৩ নায্‌যাম (মু’তাযিলি আলেম, মৃত. ২২১ হি.):

শাহরেস্তানী তাঁর সূত্রে লিখেছেন: “উমর ইবনে খাত্তাব কর্তৃক  পাঁজরের আঘাতেই মুহসিন সেকত (গর্ভপাত) হয়!”

৩.৪ ইবনে আবিল হাদীদ (মু’তাযিলি)
তিনি তাঁর উস্তাদ নকীবের সাথে আলোচনায় বলেন যে, জোরপূর্বক বায়আতের সময় মুহসিন সেকত (গর্ভপাতল হয়!

৪. রেওয়ায়াতসমূহে হযরত মুহসিন (আ.)-এর পরিচয়

৪.১ ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর রেওয়ায়াত: কিয়ামতের দিনে রাসূল (সা.), ইবরাহিম (আ.) এবং ফাতিমা (সা.আ.)-এর অবস্থান বর্ণনা করে তিনি বলেন,

কিয়ামতের দিন যখন সূচনা হবে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে ডাকা হবে। তিনি লাল রিদা পরিহিত অবস্থায় আরশের ডান পাশে দাঁড়াবেন। এরপর ইবরাহিম (আ.)-কে ডাকা হবে—তিনি সাদা রিদা পরিহিত হয়ে আরশের বাম পাশে দাঁড়াবেন। এরপর ফাতিমা (সা.আ.)-কে তাঁর সন্তানদের (নারী-পুরুষ) এবং তাঁদের শিয়াদের নিয়ে ডাকা হবে—এবং তারা সবাই হিসাব ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করবে।

তারপর আরশের গভীর থেকে নেদা (উচ্চস্বরে ঘোষণা) দেওয়া হবে:
“হে মুহাম্মদ! শ্রেষ্ঠ পিতা তোমার পিতা ইবরাহিম; শ্রেষ্ঠ ভাই তোমার ভাই আলী; শ্রেষ্ঠ সন্তান তোমার হাসান ও হুসাইন;
আর শ্রেষ্ঠ গর্ভজাত সন্তান হলো তোমার মুহসিন।”

[বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৭, পৃ. ৩২৮]

৪.২ মরহুম ফেইজ কাশানীর বর্ণনা:
“উমর ইবনে খাত্তাব তার দাস কুনফুযকে নির্দেশ দিল যে সে তার হাতে থাকা চাবুক দিয়ে ফাতিমা (সা.আ.)-কে প্রহার করুক।

কুনফুয এত আঘাত করল যে সেই চাবুকের দাগ তাঁর পিঠ ও পাঁজরে থেকে গেল। এই আঘাতগুলোই গর্ভস্থ সন্তানের সেকত (গর্ভপাত) হওয়ার প্রধান কারণ হলো—যার নাম রাসূলুল্লাহ (সা.) “মুহসিন” রেখেছিলেন!”

[নাওয়াদিরুল আখবার, পৃ. ১৮৩]

৪.৩ দাফনের বিবরণ
হযরত আলী (আ.) (হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহার সেবিকা) ফিয্‌যাহকে নির্দেশ দেন: “তাকে ঘরের শেষে দাফন করো; সে তার নানাজান রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে মিলিত হয়েছে!”

[আল-হিদায়াহ আল-কুবরা, পৃ. ৪১৭]

৫. ইমাম মাহদী (আ.)-এর যুগে মুহসিন (আ.) সম্পর্কিত রেওয়ায়াতসমূহ

ইমাম সাদিক (আ.) বর্ণনা করেন যে, “যখন ইমাম মাহদী (আ.ফা.) জুহুর করবেন… মুহসিনকে (আ.) তাঁর রক্তাক্ত অবস্থায় হযরত খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ  ও ফাতিমা বিনতে আসাদ (আ.সা.)—এ দু’জন (নানি ও দাদী)— তাঁর কাছে নিয়ে আসবেন।

তখন তাঁর মা ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) বিলাপ করবেন:
“এটাই সেই প্রতিশ্রুত দিন!”
এরপর জিবরাইল ঘোষণা দেবেন:
“এই হচ্ছে মাজলুম—একে সাহায্য করো!”
এবং মুহসিন আহ্বান করবে:
“আমি মাজলুম! আমাকে সাহায্য করো!”

৬. কুরআনের আয়াত (وَإِذَا الْمَوْءُودَةُ سُئِلَتْ) সম্পর্কে বিশ্লেষণ
মুফয্‌যালের প্রশ্নের উত্তরে ইমাম সাদিক (আ.) বলেন, সাধারণ মানুষের সেকত (গর্ভপাত) সন্তান নয়—এটি আমাদের বিষয়ে; এখানে উদ্দেশ্য মুহসিন (আ.); ‘মাওউদাহ’ শব্দটি ‘মাওয়াদ্দাহ’ থেকে এসেছে—এটি কুরবার নিকটাত্মীয়দের সাথে সম্পর্কিত। যে কেউ অন্য কথা বলবে—তাকে প্রত্যাখ্যান করো!”
[বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৫৩, পৃ. ২৩]

ঐতিহাসিক দলিল, শিয়া ও সুন্নি মৌলিক গ্রন্থ, বিভিন্ন রেওয়ায়াত এবং পরবর্তী শতাব্দীগুলোর বিশ্লেষণের আলোকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে: গৃহে হামলা একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা

সেই হামলার প্রেক্ষিতে হযরত ফাতিমা (সা.) আহত হন এবং গর্ভস্থ সন্তান মুহসিন (আ.)-এর সেকত হওয়া বহু প্রামাণিক উৎসে স্পষ্টভাবে উল্লেখিত রয়েছে।

ইমামীয় রেওয়ায়াতে মুহসিন (আ.) বিশেষ পরিচয়, মর্যাদা ও কিয়ামত-সংক্রান্ত ভূমিকার অধিকারী।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha