মঙ্গলবার ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ - ০৫:১৩
সমাজের সুস্থতার গোপন রহস্য— ভিত্তিহীন ধারণা পরিহার: আয়াতুল্লাহ জাওয়াদী আমুলি

ইসলামের দৃষ্টিতে সামাজিক জীবনের সুস্থতা ও স্থিতিশীলতা নির্ভর করে চিন্তা ও আচরণে ভারসাম্য রক্ষার উপর। চরমপন্থা ও অবহেলা—এই দুই প্রবণতাই সমাজকে বিপর্যস্ত করে। অতিরিক্ত কুধারণা যেমন সামাজিক আস্থা নষ্ট করে, তেমনি যাচাইহীন অতিরিক্ত সুধারণা ও সদ্ভাবনাও ক্ষতির কারণ হতে পারে। পবিত্র কুরআন অনুমাননির্ভর চিন্তা ও আচরণ থেকে কঠোরভাবে সতর্ক করেছে; কারণ ইসলাম হলো অনুসন্ধান, গবেষণা ও প্রমাণভিত্তিক চিন্তার ধর্ম। ভিত্তিহীন অনুমান ব্যক্তি ও সমাজ— উভয়কেই তাদের প্রকৃত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ইরানের বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন ও মারজায়ে তাকলীদ আয়াতুল্লাহ জাওয়াদী আমুলি তাঁর একটি মূল্যবান গ্রন্থে “ভিত্তিহীন ধারণা পরিহার—সমাজের সুস্থতার গোপন রহস্য” শীর্ষক আলোচনায় এ বিষয়ে গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। নিচে সেই আলোচনার সারকথা উপস্থাপন করা হলো:

ইসলামের দৃষ্টিতে, একটি সুস্থ সামাজিক জীবন গড়ে তুলতে হলে বিশ্বাস, চিন্তা ও আচরণে সব ধরনের অতিরঞ্জন ও অবহেলা পরিহার করা অপরিহার্য। মানুষ যখন জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত থাকে, তখন সে সাধারণত এই দুই চরম অবস্থার একটিতে নিপতিত হয়। এ বাস্তবতা সম্পর্কে একটি প্রসিদ্ধ উক্তি রয়েছে—

“অজ্ঞ ব্যক্তিকে তুমি এমন অবস্থায়ই দেখতে পাবে— সে হয় অতিরঞ্জনকারী, নয়তো অবহেলাকারী।”
لا تَری الجاهِلَ إلّا مُفرِطاً أو مُفَرِّطاً

এই প্রেক্ষাপটে সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ভিত্তিহীন অনুমান ও কুধারণা পারস্পরিক বিশ্বাস বিনষ্ট করে সমাজকে অস্থির করে তোলে। অপরদিকে, বাস্তবতা যাচাই না করে অতিরিক্ত সুধারণা ও সদ্ভাবনা দেখানোও বহু ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও সমাজকে ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়। তাই ইসলাম উভয় প্রবণতা থেকেই সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিয়েছে।

পবিত্র কুরআন এ বিষয়ে স্পষ্ট সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছে— یَا أَیُّهَا الَّذِینَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا کَثِیرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ
“হে মুমিনগণ! তোমরা বহু ধারণা থেকে বিরত থাকো; নিশ্চয়ই কিছু ধারণা পাপ।” (সূরা হুজুরাত, ৪৯:১২)

এই কুরআনিক নির্দেশনার পেছনে একটি সুদৃঢ় যুক্তিগত ও জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি রয়েছে, যা নিম্নোক্ত দিকগুলোতে সংক্ষেপে উপস্থাপন করা যায়—

১. ইসলাম মূলত গবেষণা, অনুসন্ধান ও প্রমাণভিত্তিক চিন্তার ধর্ম।

২. অনুসন্ধাননির্ভর চিন্তাধারা প্রমাণহীন সমর্থন ও ভিত্তিহীন অস্বীকৃতি—উভয় থেকেই মুক্ত।

৩. ধারণা যেহেতু নিশ্চিত জ্ঞান (ইয়াকিন) ও বাস্তব প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, তাই তার নিজস্ব কোনো শক্ত জ্ঞানভিত্তিক ভিত্তি নেই।

৪. যাচাই ও অনুসন্ধান ব্যতীত গমানের অনুসরণ একটি ভ্রান্ত ও বিভ্রান্তিকর পথ।

৫. এ ধরনের ভ্রান্ত চিন্তা কেবল ব্যক্তিকেই তার প্রকৃত লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয় না, বরং সামাজিক জীবনে অন্যদের অগ্রযাত্রার পথেও বাধা সৃষ্টি করে।

এই মৌলিক নীতিসমূহ পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। যেমন— وَ لَا تَقْفُ مَا لَیْسَ لَکَ بِهِ عِلْمٌ… “যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না…” (সূরা ইসরা, ১৭:৩৬)

এবং— بَلْ کَذَّبُوا بِمَا لَمْ یُحِیطُوا بِعِلْمِهِ “বরং তারা এমন বিষয়কে অস্বীকার করেছে, যার পূর্ণ জ্ঞান তারা অর্জন করতে পারেনি।” (সূরা ইউনুস, ১০:৩৯)

*তথ্যসূত্র:* এই আলোচনা আয়াতুল্লাহ জাওয়াদী আমুলি রচিত গ্রন্থ “কুরআনের দৃষ্টিতে সমাজ” (جامعه در قرآن), পৃষ্ঠা ২৪১ থেকে সংকলিত।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha