বুধবার ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ - ১০:০১
পবিত্র কুরআন কীভাবে অক্ষুণ্ণ রইল?

ইরানের ধর্মীয় নগরী কোমের হাওজায়ে ইলমিয়ার প্রখ্যাত উস্তাদ আয়াতুল্লাহ আলী র’ব্বানি গুলপলয়গনি বলেছেন, কুরআনের সংরক্ষণ ও সংকলন একেবারেই অক্ষুণ্ণ এবং নির্ভরযোগ্য। তিনি জানান, সর্বপ্রথম কুরআন সংকলন ও লিপিবদ্ধ করার উদ্যোগ নেন হযরত আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.), যা তিনি সরাসরি রাসূলুল্লাহর (সা.) নির্দেশে সম্পন্ন করেন।

হাওজা নিউজ এজেন্সি’র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “কুরআন সংরক্ষণ ও সংকলনের বিষয়টি ইসলামের প্রারম্ভিক যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা গভীরভাবে আলোচিত হওয়া প্রয়োজন।”

কুরআনের সংরক্ষণ নিয়ে সংশয়
আয়াতুল্লাহ গুলপয়গনি বলেন, অনেকেই প্রশ্ন তোলেন যে—রাসূলুল্লাহর (সা.) যুগে আদিম উপকরণ, সীমিত সাক্ষরতা এবং আরবি লিপিতে বিন্দু ও ই‘রাব না থাকার কারণে কুরআন কি অক্ষুণ্ণ থাকতে পেরেছিল?

তিনি যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করেন—প্রাথমিক লেখনী সরঞ্জাম সত্ত্বেও কুরআন সংরক্ষণে কোনো ঘাটতি হয়নি, কেবল কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল।

সে যুগে সাক্ষর মানুষের সংখ্যা একেবারে কম ছিল না, বরং কুরআন লিপিবদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট ছিল।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, বিপুল সংখ্যক সাহাবি কুরআন মুখস্থ করেছিলেন এবং নবী করীম (সা.) নিজেই হিফজ ও তিলাওয়াতকে উৎসাহিত করতেন।

যুক্তি ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা
আয়াতুল্লাহ র’ব্বানি গুলপয়গনি বলেন, “ধরে নিলেও যদি কেউ নবীজির (সা.) ‘ইসমত’ অস্বীকার করে, তবুও একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবে তিনি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করতেন যাতে তাঁর আনা বার্তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অক্ষুণ্ণ থাকে। তাই যৌক্তিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়, কুরআন সংরক্ষণের জন্য সব ব্যবস্থা তিনি গ্রহণ করেছিলেন।”

তিনি আরও যোগ করেন, ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে যে, অনেক সাহাবি নিজেদের লিপিবদ্ধ আয়াত নবীজির (সা.) কাছে উপস্থাপন করতেন। এ থেকেই স্পষ্ট হয় যে কুরআনের সংরক্ষণ যৌক্তিক ও ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত।

হযরত আলীর (আ.) ভূমিকা
তিনি জোর দিয়ে বলেন, কুরআনের প্রধান লিপিকার ছিলেন হযরত আলী (আ.)। তিনি রাসূলুল্লাহর (সা.) সমস্ত ওহি ও বক্তব্য লিপিবদ্ধ করতেন। এ কারণে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, কুরআন নবীজির (সা.) যুগেই সংরক্ষিত ছিল।

নবীজির (সা.) ইন্তেকালের পর সংকলন
আয়াতুল্লাহ গুলপয়গনি বলেন, রাসূলুল্লাহর (সা.) ইন্তেকালের পর কুরআন সংকলন প্রসঙ্গে দুটি মত পাওয়া যায়:

১. নবীজির (সা.) জীবদ্দশায় পুরো কুরআন লেখা হয়েছিল, তবে বর্তমান সুনির্দিষ্ট ক্রমানুসারে সাজানো হয়নি। এই কাজ পরে সম্পন্ন হয়।

২. অপর একটি মত অনুযায়ী, নবীজির (সা.) জীবদ্দশাতেই কুরআন বর্তমান আকারে সংকলিত হয়েছিল।

তিনি উল্লেখ করেন— হযরত আলী (আ.) নবীজির (সা.) নির্দেশে কুরআন সংগ্রহ করেছিলেন।

পরে প্রথম খলিফার নির্দেশে এবং দ্বিতীয় খলিফার প্রস্তাবে যায়েদ ইবনে সাবিতের নেতৃত্বে একটি কমিটি কুরআন পুনরায় সংকলন করে। সেখানে নিয়ম ছিল, লিখিত দলিল ছাড়া আয়াত গ্রহণ না করা; তবে দুজন সাক্ষীর সাক্ষ্য থাকলে গ্রহণযোগ্য হবে। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল খুজায়মা (রা.)-এর সাক্ষ্য, যাকে রাসূলুল্লাহ (সা.) দুইজনের সমতুল্য বলেছেন।

আলেম-উলামাদের ভিন্নমত
শিয়া আলেম আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ হাদী মারেফাত বলেন, নবীজির (সা.) সময়ে কুরআনের সব অংশ লেখা হয়েছিল, তবে একত্রিত হয়নি।

সুন্নি আলেম সুয়ূতিও একই মত প্রকাশ করেন।

আল্লামা তাবাতাবায়ী বলেন, “কুরআন নবীজির (সা.) যুগে পূর্ণাঙ্গ সংকলিত হয়নি; বরং সূরা ও আয়াতগুলো বিচ্ছিন্নভাবে মানুষের হাতে ছিল।”

ইমাম সাদিক (আ.) বর্ণনা করেন যে, নবীজির (সা.) নির্দেশে হযরত আলী (আ.) লিপিবদ্ধ আয়াতসমূহ সংগ্রহ করেন।

অন্যদিকে, সুন্নি ও শিয়া উভয় মাযহাবের কিছু আলেম যেমন কাদী আবু বকর বাকিলানি, ইবনে আনবারি, কেরমানি, তায়িবী, সাইয়্যেদ মুরতজা, তাবারসি এবং আয়াতুল্লাহ খুয়ী (রহ.) বিশ্বাস করেন যে, কুরআন নবীজির (সা.) জীবদ্দশাতেই বর্তমান রূপে সংকলিত হয়েছিল।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha