হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, মানবজীবন—ব্যক্তিগত ও সামাজিক—প্রধানত দুটি শক্তির মধ্যে গড়ে ওঠে: একদিকে ঈমান, ন্যায় ও আদর্শ; অন্যদিকে লোভ, উদাসীনতা ও অনুগতি-বিবর্ণতা। যখন কোনো সমাজ আল্লাহর নির্দেশিত ন্যায়পরায়ণ নেতৃত্ব বা নৈতিক আদর্শকে গ্রহণ না করে, তখন তা শুধু বাহ্যিক শক্তিতে ভর করে; আর এর ফলশ্রুতিই আমরা ইতিহাসে বারবার দেখতে পাই। আমিরুল মুমিনীন (আ.)-এর শেষ কালীন আর্তি ও খুতবাগুলোতে এই সত্যের এক হৃদয়গ্রাহী প্রতিফলন মিশে আছে — যেভাবে তিনি ক্লান্তি, বেদনাবোধ ও সমগ্র জাতির প্রতি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ইমামের ক্লান্তি: ব্যক্তিগত না, অনুগামীর প্রতি হতাশা
ইমাম আলী (আ.) যখন বলছিলেন,
اللهم إني قد مَلِلْتُ، ومَلُّوني
سَئِمْتُهُم، وسَئِمُوني
(হে আল্লাহ, আমি তাদের থেকে ক্লান্ত হয়েছি, আর তারা আমার থেকে বিরক্ত হয়ে গেছে; আমি তাদের থেকে বিরক্ত হয়েছি, আর তারা আমার থেকে বিরক্ত হয়েছে) — সেখানে মৌলিকভাবে ব্যক্তিগত উদ্বেগ নেই; বরং তা একটি নেতার মনোবেদনা, যিনি দেখে থাকেন তাঁর অনুসারীরা কথার গভীরতা উপলব্ধি করে না, আদর্শ মেনে চলে না, এবং তাই নেতৃত্ব ও অনুগত জনতার মধ্যে সম্পর্ক ভেঙে পড়ছে।
এই ক্লান্তি হল—ভালোবাসার অতিরিক্ত আঘাত। যে নেতা সত্য, ন্যায় ও ত্যাগ দেখান, কিন্তু তাঁর অনুসারীরা সেই আদর্শ গ্রহণ না করে পেছনে যায়; ফলে নেতা প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মধ্যে দ্বিধায় পড়েন। এটাই ইমাম আলীর আর্তি—কিন্তু তা একই সঙ্গে একটি সতর্কবার্তা: সমাজ যখন আল্লাহতন্ত্রের নৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়, তখন তার ভবিষ্যৎ অন্ধকারময় হয়।
জাতিগত অযোগ্যতার পরিণতি: বদলে যাওয়ার আশঙ্কা এবং ইতিহাসের সতর্কতা
ইমাম উক্ত খুতবায় আরও বলেন:
فابدلنی بهم خیرا منهم
(হে আল্লাহ, এদের পরিবর্তে আমাকে তাদের চেয়ে উত্তম মানুষ দাও।)
এবং পরে:
و ابدلهم بی شرّا منی
(হে আল্লাহ, আমাকে এদের কাছ থেকে সরিয়ে নাও এবং এমন কাউকে দাও যাকে এরা প্রাপ্য — তাদের মতোই একজন শাসক।)
এই দোয়ার ভাষায় একটি শক্ত প্রতিজ্ঞা ও ইতিহাসের নীরব সতর্কবাণী লুকিয়ে আছে: যদি কোনো জাতি তার নেতা, মুশতাক আদর্শ ও নৈতিক বিধানকে গ্রহণ না করে, তাহলেই আল্লাহ তাদেরকে তাদের মতোই লোভী, ন্যায়হীন ক্ষমতাসীনতার অধীনে ছেড়ে দিতে পারেন। ইতিহাসও এ রকম উদাহরণ দিয়ে ভরা—প্রকৃত অনুগামীর অভাব হলে সমাজ সহজেই খারাপ নেতৃত্বের শিকার হয়, এবং পরিণতি হয় নিষ্ঠুরতা, সংঘাত ও বিধ্বংসে।
ইমামের কথাগুলোতে ঐক্যবদ্ধভাবে আশা, হতাশা ও সতর্কতা পরিলক্ষিত হয়। তিনি চান তাঁর ন্যায়পরায়ণ নেতৃত্বের প্রতি মানুষ যদি শ্রদ্ধাশীল না হয়, আল্লাহ তাঁর আকাঙ্ক্ষা পূরণ করুক—তবে সেটা নেতার বদলা নয়; বরং সেই জাতির নৈতিক প্রাপ্যতার প্রতিফলন। ইমামের কষ্ট-উচ্চারন শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি একটি জাতীয় আত্মপরীক্ষা: তুমি কি সেই স্পিরিচুয়াল ও নৈতিক যোগ্যতা রাখো যে তোমার ওপর ন্যায়পরায়ণ নেতৃত্ব অর্পিত হতে পারে?
লবণের উদাহরণ: ম্লান হৃদয় ও তীব্র শাস্তি
ইমাম বলছিলেন:
اللّهم مث قلوبهم کما یماث الملح فی الماء
(হে আল্লাহ, তাদের হৃদয়গুলোকে এমনভাবে কষ্ট দাও, যেমন লবণ পানির সংস্পর্শে গলে যায়।)
এই তুলনায় লবণ-পানির মধ্যকার মিশিষ্য রসায়ন দৃশ্যায়িত হয়: লবণ একসাথে মেশে, ধরা পড়ে না; কিন্তু তার স্বাদ ও প্রভাব জলকে বদলে দেয়। ইমামের ইচ্ছা ছিল—যে লোকেরা তাঁর কথার মর্ম উপলব্ধি করে না, তাদের হৃদয় যেন এমনভাবে কষ্ট-বেদনায় পরিপূর্ণ হয় যাতে তারা বুঝতে পারে তাদের অনুগতিহীনতা ও কৃতঘ্নতা কতটা বিপজ্জনক। তবে এখানে লক্ষ্যণীয়: ইমামের এই আর্তি দণ্ডচেতনার নয়, বরং একটি সতর্কীকরণ—যে নৈতিক অজ্ঞতা ও অনুগত্যহীনতা সমাজকে ভেঙে দিতে পারে।
সাহসীর আকাঙ্ক্ষা: পরিমাণ নয় গুণমানের আহ্বান
ইমাম আরও বলেছিলেন যে তিনি কুফার বড় সেনাবাহিনীর বদলে চান এক হাজার প্রকৃত, বীর বিশ্বাসী। এ কথায় একটি গভীর নৈতিক শিক্ষা লুকিয়ে আছে: সংখ্যায় বড় হওয়া কোনো নিশ্চিত গুণ নাও। প্রকৃত অনুগত—যারা ন্যায়ে, ঈমান ও ত্যাগে দৃঢ়—তারা সংখ্যার সীমা অতিক্রম করে সমাজকে গঠন করে। ইমামের আশা ছিল কৃতজ্ঞতা ও বিশ্বাসভিত্তিক সমর্থন—যা সংখ্যাগত কর্তৃত্বকে টিকে থাকার যোগ্যতা দেয়।
কার্যকরী শিক্ষা: আজকের সমাজের জন্য চারটি মূল বার্তা
১. ধারণক্ষমতা ও অনুগত্যগুণ: নেতা-শিক্ষকের কথা গ্রহণ না করলে সমাজ ধীরে ধীরে নৈতিক শূন্যতায় পড়ে—একটি জাতির অনুকূল ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার অনুসারীর আন্তরিকতায়।
২. গুণমান বনাম পরিমাণ: বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা সব সময় ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে না; প্রকৃত পরিবর্তন আসে মর্মপীড়িত ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিদের মাধ্যমে।
৩. কৃতজ্ঞতা ও ইমানের গুরুত্ব: দৈব অনুগ্রহ ও ন্যায়পরায়ণ নেতৃত্ব যদি কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ না করা হয়, তবে ফলশ্রুতির জটিলতা ও বিপর্যয় অনিবার্য।
৪. ঐতিহাসিক সতর্কতা: অতীতের ঘটনা—যেমন ইমামের আর্তি ও তার পরিণত ইতিহাস—আমাদের অনুশীলন ও নৈতিক সিদ্ধান্তগুলো পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানায়।
ইমাম আলী (আ.)-এর শেষ খুতবা ও আর্তি কেবল অতীতের বেদনার কণ্ঠ নয়; এটি একটি স্থায়ী সতর্কবাণী, যা আজও আমাদের প্রজন্মকে জাগাতে পারে। দৈব অনুগ্রহের প্রতি অকৃতজ্ঞতা কেবল ব্যক্তি বা সময়ের সমস্যা নয়—এটি একটি সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক বিপর্যয়ের বীজ। যদি আমরা নেতাদের বক্তব্যের গভীরতা না বুঝি, তাদের ত্যাগ ও ন্যায়কে অবজ্ঞা করি, তবে ইতিহাসের ন্যায়ই আমাদেরও কঠোর ফল ভোগ করতে হতে পারে। কিন্তু যদি আমরা ইমামের আহ্বান থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের সম্মিলিতভাবে নিত্যনতুন সততা, কৃতজ্ঞতা ও সাহসিকতায় সাজাই—তবে এক জনাই নয়, সমগ্র সমাজই বদলে যাবে; এবং ঐ দাস্যজ দুঃখের বদলে উঠে আসবে জীবন্ত ন্যায়ের জ্যোতি।
রিপোর্ট: হাসান রেজা
আপনার কমেন্ট