শুক্রবার ১৭ অক্টোবর ২০২৫ - ২০:২১
বেহায়াপনা ও নির্লজ্জতার প্রসার পশ্চিমা ষড়যন্ত্র— যার উদ্দেশ্য সমাজকে নৈতিক অধঃপতনের দিকে ঠেলে দেওয়া

আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ রেজা নাসেরি সতর্ক করেছেন— বেহিজাবি ও নির্লজ্জতার প্রসার পশ্চিমা বিশ্বের অন্যতম পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যার উদ্দেশ্য সমাজকে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া এবং পরিবার নামক পবিত্র প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ইয়াজদের সাপ্তাহিক জুমার খুতবায় জুমার ইমাম বলেন, আল্লাহ তাআলা বিশ্বজগতকে কোনোভাবেই উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেননি; প্রতিটি সৃষ্টিই প্রজ্ঞা ও হিকমতের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট দায়িত্ব বহন করছে। সমগ্র সৃষ্টি মানুষের সেবায় নিয়োজিত, যাতে মানবজীবনের পরিপূর্ণতার পথ সুগম হয় এবং সে আল্লাহর নিকটবর্তী হতে পারে।

তিনি বলেন, নবী-রাসুলগণ মানুষকে এই সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্যই প্রেরিত হয়েছেন, আর এ পথ থেকে বিচ্যুতি ছাড়া মানুষের জন্য ফলাফল কিছুই নয়— কেবল ক্ষতি ও গোমরাহি।

আয়াতুল্লাহ নাসেরি আরও বলেন, প্রকৃত সফলতার পথে যাত্রার জন্য “রসদ” হলো আল্লাহর ওপর পূর্ণ নির্ভরতা। যে কোনো কাজ যা মানুষকে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, তা নিঃসন্দেহে বড় ভুল।

ধৈর্য: দৃঢ়তার স্তম্ভ ও চিরস্থায়ী লাভজনক বাণিজ্য
ইয়াজদের জুমার ইমাম ধৈর্যকে মানুষের “মাথা”-এর সঙ্গে তুলনা করে বলেন, যার মধ্যে ধৈর্য নেই, তার যেন দেহ নেই— সে দৃঢ়তার ভিত্তি হারিয়ে ফেলে। মুমিন ব্যক্তি দুনিয়ার কষ্টে ধৈর্য ধারণ করে আসলে এক লাভজনক বাণিজ্যে অংশ নেয়; কারণ ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার বিপরীতে আখিরাতের সুখ চিরস্থায়ী।

তিনি ধৈর্যের তিনটি মৌলিক দিক ব্যাখ্যা করেন—
১️. বিপদ ও দুঃখ-কষ্টে ধৈর্য,
২️. পাপের প্ররোচনার সামনে ধৈর্য,
৩️. এবং আল্লাহর আনুগত্যে ধৈর্য।

পাপের মুখে ধৈর্য মানুষকে আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহের যোগ্য করে, আর আনুগত্যে ধৈর্য তাকে নিয়মিতভাবে ফরজ ও ওয়াজিব আমলে অবিচল রাখে।

তিনি বলেন, যে জাতি প্রতিকূলতার মুখে ধৈর্য ও প্রতিরোধ হারায়, সে জাতি অবশেষে অপমানিত হয়। যেমন, গাজার জনগণের ধৈর্য ও স্থিতিশীলতা আজ তাদের মর্যাদাকে বিশ্ববাসীর সামনে উজ্জ্বল করেছে এবং দখলদার জায়োনিস্ট শাসনের নিষ্ঠুর মুখ উন্মোচিত করেছে।

আয়াতুল্লাহ নাসেরি সূরা রূমের ৬০ নম্বর আয়াত উল্লেখ করেন—
فَاصْبِرْ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ
“অতএব ধৈর্য ধর; নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য।”

তিনি বলেন, ইসলাম, বিপ্লব ও নেতৃত্বের পথে অবিচল থাকা প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য, এবং ইরান জাতি এ ক্ষেত্রে ধৈর্য ও প্রতিরোধের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

নেতৃত্ব ও ভালোবাসা: তিনটি মৌলিক নীতি
খুতবার দ্বিতীয় অংশে আয়াতুল্লাহ নাসেরি “ইমামত ও নেতৃত্ব”-এর তিনটি মূল নীতি ব্যাখ্যা করেন:
১️. বেলায়াত (নেতৃত্ব),
২️. ইতাআত (আনুগত্য),
৩️. মাওয়াদ্দাত (ভালোবাসা ও স্নেহ)।

তিনি কুরআনের নির্দেশের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, আল্লাহ, রাসুল (সা.) ও ‘ওলিল আমর’-এর আনুগত্য একটি ঈমানি নীতি, এবং এর পাশাপাশি রাসুলের নিকট আত্মীয়দের প্রতি মাওয়াদ্দাত বা ভালোবাসা— যা নবী করীম (সা.) তাঁর রিসালতের প্রতিদান হিসেবে ঘোষণা করেছেন— তা ইসলামী জীবনে অপরিহার্য বিষয়।

মাওয়াদ্দাত যদি হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে নেতৃত্ব ও আনুগত্য স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বাস্তবায়িত হয়, বলেন ইয়াজদের জুমার ইমাম।

শক্তিশালী ইরান গঠনের অপরিহার্যতা
আয়াতুল্লাহ নাসেরি বলেন, আল্লাহ তাআলা কুরআনে নির্দেশ দিয়েছেন—
وَ أَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ
“তোমরা যতটা সম্ভব শক্তি প্রস্তুত রাখ।”

তিনি বলেন, মুসলমানদের উচিত— জ্ঞান-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজ ও প্রতিরক্ষা— প্রতিটি ক্ষেত্রে শক্তিশালী হওয়া, যাতে শত্রুরা লোভ করতে না পারে এবং ইসলামের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে।

“মর্যাদা বা ইজ্জত আল্লাহ ও মুমিনদের জন্যই; আর তা কেবল শক্তি ও সক্ষমতার মাধ্যমে রক্ষা করা সম্ভব।”

তিনি বলেন, জ্ঞানই শক্তির মূল চাবিকাঠি। তাই বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখা অপরিহার্য। উচ্চতর বৈজ্ঞানিক সাফল্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরানের মর্যাদা বৃদ্ধি করে এবং শত্রুর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়। এজন্য প্রয়োজন—

মেধাবী তরুণদের যথাযথ লালন
• বিদ্যালয়ে চিন্তাশীল সংস্কৃতি গড়ে তোলা,
• এবং গবেষক ও শিল্পখাতের মধ্যে কার্যকর সংযোগ স্থাপন।

অর্থনীতির ক্ষেত্রে তিনি বলেন, কৃষিক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সমাজের স্বাস্থ্য ও জীবন এর সঙ্গে যুক্ত। পাশাপাশি পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পখাতেও স্বনির্ভরতা অর্জন করা উচিত।

নারীর মর্যাদা ও পশ্চিমা সংস্কৃতির ফাঁদ
দিকনির্দেশনামূলক বার্তায় আয়াতুল্লাহ নাসেরি মেয়েদের ও নারীদের উদ্দেশে বলেন, জীবনের পথ ও বন্ধুত্ব বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান ও নৈতিকতার পথ অনুসরণ করা আবশ্যক।

তিনি সতর্ক করেন, “বেহিজাবি বা বেহায়াপনা পশ্চিমা বিশ্বের এক সাংস্কৃতিক চক্রান্ত, যা সমাজকে নৈতিক অধঃপতনের দিকে ঠেলে দেয় এবং সুস্থ পারিবারিক বন্ধনকে দুর্বল করে।”

জুমার ইমাম পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানান— তারা যেন আগামী প্রজন্মকে সুরক্ষিত রাখতে সচেষ্ট থাকেন এবং নৈতিক বিচ্যুতি রোধে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেন।

গাজা ও প্রতিরোধের অনুপ্রেরণা
শহিদ ইয়াহইয়া সিনওয়ারের শাহাদাতবার্ষিকীতে তিনি তাঁর উক্তি স্মরণ করেন— “আমি আমার পথ শিখেছি ইমাম হোসাইন (আ.) থেকে।”

আয়াতুল্লাহ নাসেরি বলেন, এই উক্তিটি এক ফিলিস্তিনি মুজাহিদের দৃঢ় বিশ্বাস ও আত্মত্যাগের গভীর বার্তা বহন করে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কারবালার আন্দোলন আজও বিশ্বের মুক্তিকামীদের অনুপ্রেরণার উৎস।

ইরানের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান ও সামাজিক আহ্বান
ইরানের পক্ষ থেকে “শার্ম আল-শেখ সম্মেলনে” অংশ না নেওয়া ছিল এক মর্যাদাপূর্ণ ও সাহসী সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করেন আয়াতুল্লাহ নাসেরি। তিনি বলেন, “এটি ছিল আমেরিকা ও পশ্চিমা প্রভুত্বের সামনে দেশের সম্মান ও স্বাধীনতা রক্ষার এক বাস্তব পদক্ষেপ।”

শেষে তিনি দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান—
• অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি ও বাজারের বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা,
• এবং নিত্যদিনের ব্যায়াম ও শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখার অভ্যাস গড়ে তোলা।

আয়াতুল্লাহ নাসেরির জুমার খুতবা একাধারে আধ্যাত্মিক ও সামাজিক দিকনির্দেশনা বহন করে। এতে যেমন ধৈর্য, আনুগত্য ও নৈতিকতার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তেমনি শক্তিশালী ইসলামি সমাজ গঠনের পথও নির্দেশ করা হয়েছে। তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট— ইসলামি সমাজের প্রকৃত শক্তি নিহিত আছে ঈমান, জ্ঞান, ধৈর্য ও নৈতিক পবিত্রতায়; আর পশ্চিমা অনৈতিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাই আজকের সবচেয়ে জরুরি দায়িত্ব।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha