বুধবার ২২ অক্টোবর ২০২৫ - ০৯:৫৪
যেসব কারণে ইরানের পারমাণবিক প্রযুক্তি প্রয়োজন

অনেকে এখনো মনে করেন যে পারমাণবিক প্রযুক্তি মানেই অস্ত্র তৈরি বা সামরিক প্রতিযোগিতা। কিন্তু বাস্তবে এই ধারণা একপেশে ও অসম্পূর্ণ। আধুনিক যুগে পারমাণবিক প্রযুক্তি শুধু প্রতিরক্ষা নয়, বরং শান্তিপূর্ণ উন্নয়নের এক শক্তিশালী হাতিয়ার। বিদ্যুৎ উৎপাদন, চিকিৎসা, কৃষি, পানি বিশুদ্ধকরণ, খাদ্য সংরক্ষণ—মানবজীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর প্রয়োগ আজ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। বৈজ্ঞানিকভাবে উন্নত ও আত্মনির্ভর রাষ্ট্র গঠনের জন্য তাই এই প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার যে কোনো জাতির অগ্রগতির অপরিহার্য শর্ত।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: যে কোনো দেশ শক্তিশালী ও স্বাধীন হতে চাইলে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অর্জন তার জন্য অপরিহার্য। এর মধ্যে অন্যতম হলো পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার।

বাড়িঘরে বিদ্যুৎ জোগানো থেকে শুরু করে চিকিৎসা ও কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতি—শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক প্রযুক্তি আজ এক নীরব অথচ অপরিহার্য সঙ্গী, যা ইরানকে আরও উন্নত, স্বাস্থ্যসম্মত ও স্বনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করতে সাহায্য করছে।

আধুনিক শিল্পোন্নত সমাজে পারমাণবিক প্রযুক্তি এবং এর বহুমুখী ব্যবহার এখন দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কোনো দেশ কতটা পরিমাণে এই প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ সুবিধা ভোগ করতে পারে, সেটিই তার উন্নয়নের মাত্রা নির্ধারণ করে।

ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী দীর্ঘদিন ধরে এই প্রযুক্তি অর্জনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। তিনি বলেছেন, এটি শুধু একটি বৈজ্ঞানিক অর্জন নয়, বরং জাতির অগ্রগতি ও আত্মনির্ভরতার প্রতীক।

সর্বোচ্চ নেতার দৃষ্টিতে পারমাণবিক শক্তির গুরুত্ব
২০০৬ সালের ১৫ জুন এক ভাষণে আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বলেন, ‘আমাদের দেশে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের গুরুত্ব তেল আবিষ্কারের চেয়েও বেশি।’

পরে, ২০১৫ সালের ৯ এপ্রিল তিনি বলেন, ‘পারমাণবিক শিল্প একটি দেশের জন্য অপরিহার্য—বিদ্যুৎ উৎপাদন, চিকিৎসা, সমুদ্রের পানি বিশুদ্ধ করা, কৃষি এবং আরও বহু ক্ষেত্রে এটি প্রয়োজনীয়। এটি একটি উচ্চমানের ও গুরুত্বপূর্ণ শিল্প।’

২০২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি আরও বলেন, ‘আরও কয়েক বছরের মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিশ্বের অন্যতম প্রধান জ্বালানি উৎসে পরিণত হবে। যখন তেল শেষ হবে বা অন্য কাজে ব্যবহৃত হবে, তখন পারমাণবিক শক্তিই হবে পরিচ্ছন্ন, সাশ্রয়ী ও টেকসই শক্তির উৎস।’

পরিচ্ছন্ন ও স্থিতিশীল বিদ্যুতের উৎস
পারমাণবিক শক্তির সবচেয়ে বড় ব্যবহার বিদ্যুৎ উৎপাদনে। পরমাণু বিভাজন থেকে সৃষ্ট বিপুল তাপ নিরাপদভাবে একটি রিয়্যাক্টরে নিয়ন্ত্রণ করে বাষ্প তৈরি করা হয়, যা টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।

এই বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়া আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল নয় এবং জীবাশ্ম জ্বালানির মতো বায়ুদূষণও করে না। অল্প পরিমাণ পারমাণবিক জ্বালানি থেকে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব, যা দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে।

চিকিৎসাক্ষেত্রে পারমাণবিক প্রযুক্তি
চিকিৎসা বিজ্ঞানে পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে।

রেডিওফার্মাসিউটিক্যাল নামের এক বিশেষ ওষুধে সামান্য পরিমাণ তেজস্ক্রিয় উপাদান থাকে, যা রোগীর শরীরে প্রবেশের পর নির্দিষ্ট অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্রম নির্ণয়ে সাহায্য করে।

এভাবে প্রাথমিক পর্যায়েই ক্যান্সার, হৃদরোগ বা অন্যান্য জটিলতা শনাক্ত করা যায়। একইভাবে, রেডিওথেরাপি ও ব্র্যাখিথেরাপি ক্যান্সার চিকিৎসায় কার্যকর অস্ত্র হিসেবে কাজ করছে।

এছাড়া অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত লেজার ও চিকিৎসা সরঞ্জাম নির্বীজ করতে পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে, যা সংক্রমণ রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

কৃষিক্ষেত্রে পারমাণবিক প্রযুক্তির ভূমিকা
পারমাণবিক প্রযুক্তি কৃষিক্ষেত্রেও আশীর্বাদস্বরূপ। এটি কীটপতঙ্গ দমন, উন্নত জাতের ফসল উদ্ভাবন ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নে সহায়তা করে।

‘স্টেরাইল ইনসেক্ট টেকনিক’ পদ্ধতিতে তেজস্ক্রিয়তার সাহায্যে পুরুষ কীটকে বন্ধ্যা করে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হয়, ফলে তাদের বংশবিস্তার বন্ধ হয়ে যায়—এভাবে পরিবেশবান্ধব উপায়ে ফসল রক্ষা করা সম্ভব।

একইভাবে, সামান্য বিকিরণের মাধ্যমে নতুন প্রজাতির শস্য তৈরি করা যায়, যা খরা, লবণাক্ততা ও রোগ প্রতিরোধে সক্ষম।

পানি ও খাদ্য নিরাপত্তায় অবদান
পারমাণবিক শক্তি সমুদ্রের পানি বিশুদ্ধ করে পানযোগ্য করার পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির উৎস সনাক্ত ও বাঁধের ফাটল শনাক্ত করতে সাহায্য করে। খাদ্যে বিকিরণ প্রয়োগের মাধ্যমে তা দীর্ঘস্থায়ী রাখা সম্ভব, যা খাদ্য অপচয় কমায়।

বিদ্যুৎ, চিকিৎসা ও কৃষি—সব ক্ষেত্রেই পারমাণবিক প্রযুক্তি আধুনিক সমাজের অপরিহার্য অংশ। ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি কেবল বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের পথ নয়; এটি জাতীয় স্বনির্ভরতা, টেকসই উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণে বিনিয়োগ।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha