বুধবার ২৯ অক্টোবর ২০২৫ - ১১:০১
ইমাম আলীর (আ.) ঐতিহাসিক সতর্কবার্তা: নেতৃত্বের পরীক্ষায় উম্মাহর ভবিষ্যৎপ

সমাজ প্রতিদিন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়—অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি কিংবা নৈতিকতা। এই প্রতিটি সংকটে নেতৃত্বের ভূমিকা নির্ধারণ করে জাতির ভবিষ্যৎ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দৃষ্টিশক্তিহীন ও ন্যায়বিচারহীন নেতৃত্ব শুধু নিজেকে নয়, গোটা জাতিকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। এমন সময়েই আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠে আল্লাহপ্রেরিত নেতাদের বাণী। ইমাম আলী (আ.)-এর ঐতিহাসিক সতর্কবার্তা, আজও আমাদের জন্য এক অনন্য দিকনির্দেশনা।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ইমাম আলী (আ.) মদিনাবাসীর বায়াতের দিনে, উম্মাহর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান নিয়ে ইসলামী সমাজের নেতাদের উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা প্রদান করেন। তিনি বলেন:

ذِمَّتِی بِمَا أَقُولُ رَهِینَةٌ وَ أَنَا بِهِ زَعِیمٌ، إِنَّ مَنْ صَرَّحَتْ لَهُ الْعِبَرُ عَمَّا بَیْنَ یَدَیْهِ مِنَ الْمَثُلَاتِ حَجَزَتْهُ التَّقْوَى عَنْ تَقَحُّمِ الشُّبُهَاتِ، أَلَا وَ إِنَّ بَلِیَّتَكُمْ قَدْ عَادَتْ كَهَیْئَتِهَا یَوْمَ بَعَثَ اللَّهُ نَبِیَّهُ (صلی الله علیه وآله)، وَ الَّذِی بَعَثَهُ بِالْحَقِّ لَتُبَلْبَلُنَّ بَلْبَلَةً وَ لَتُغَرْبَلُنَّ غَرْبَلَةً وَ لَتُسَاطُنَّ سَوْطَ الْقِدْرِ حَتَّى یَعُودَ أَسْفَلُكُمْ أَعْلَاكُمْ وَ أَعْلَاكُمْ أَسْفَلَكُمْ وَ لَیَسْبِقَنَّ سَابِقُونَ كَانُوا قَصَّرُوا وَ لَیُقَصِّرَنَّ سَبَّاقُونَ كَانُوا سَبَقُوا، وَ اللَّهِ مَا كَتَمْتُ وَشْمَةً وَ لَا كَذَبْتُ كِذْبَةً وَ لَقَدْ نُبِّئْتُ بِهَذَا الْمَقَامِ وَ هَذَا الْیَوْمِ.

আমি যা বলছি, তার প্রতি আমার অঙ্গীকার রয়েছে এবং আমি তার সাক্ষ্য দিচ্ছি। যে ব্যক্তি অতীতের ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, তাকওয়া তাকে সন্দেহ ও বিভ্রান্তির পথ থেকে রক্ষা করে। জেনে রাখো, তোমাদের পরীক্ষা ঠিক সেই দিনের মতো হবে যেদিন আল্লাহ তাঁর নবীকে প্রেরণ করেছিলেন। আমি সেই সত্যের কসম করে বলছি, তোমরা অস্থিরতা ও কঠিন ছাঁকনির মধ্য দিয়ে যাবে। তোমাদের মধ্যে নিচেররা উপরে উঠবে, আর উপরেররা নিচে নেমে যাবে। যারা অবহেলা করেছে, তারা অগ্রগামী হবে, আর যারা অগ্রগামী ছিল, তারা পিছিয়ে পড়বে। আল্লাহর কসম, আমি কোনো সত্য গোপন করিনি, কোনো মিথ্যা বলিনি, এবং এই দিন ও অবস্থার পূর্বাভাস আমাকে দেওয়া হয়েছে।সূত্র: নাহজুল বালাগা, খুতবা ১৬।

এই বক্তব্যে ইমাম (আ.) একটি চিরন্তন সত্য তুলে ধরেন—আল্লাহর নিয়মে পরীক্ষা ও ছাঁকনি অবধারিত। নেতৃত্বের আসন কোনো ব্যক্তির জন্য স্থায়ী নয়। দায়িত্বে অবহেলা, আত্মকেন্দ্রিকতা বা ন্যায়বিচার থেকে বিচ্যুতি—সবই একদিন প্রকাশিত হবে। আল্লাহর নিয়মে কেবল তাকওয়া ও ন্যায়ের ভিত্তিতেই সমাজের স্থিতি রক্ষা পায়।

ইমাম আলী (আ.)-এর ভাষায়, ইসলামী সমাজ সবসময়ই পরীক্ষার মুখে থাকে। যারা দায়িত্বে অবহেলা করেছে, তারা হয়তো অগ্রগামী হয়ে উঠবে, আর যারা আগে থেকেই অগ্রণী ছিল, তারা পিছিয়ে পড়বে। এটি আল্লাহর একটি নিয়ম, যা আমাদের শেখায়—কোনো পদ বা মর্যাদা স্থায়ী নয়, সবাইকে তাকওয়া ও দায়িত্ববোধের সঙ্গে কাজ করতে হবে।

এই সতর্কবার্তার অন্যতম মূল শিক্ষা হলো—বস্তুগত নয়, বরং অন্তর্দৃষ্টি ও অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণই নেতৃত্বের প্রকৃত শক্তি। যে ব্যক্তি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়, তাকওয়া তাকে সঠিক পথে রাখে এবং সমাজকে বিভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা করে।

ইমাম আলী (আ.)-এর বাস্তবিক পরামর্শ হলো—নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের উচিত সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকা, ক্ষমতার মোহ ও দুর্নীতির পথ পরিহার করা। কেবল তখনই উম্মাহ অস্থিরতা ও বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকবে এবং আল্লাহর নিয়ম সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে।

এই বাণী শুধু একটি ঐতিহাসিক সতর্কতা নয়, বরং আজকের নেতৃত্বের জন্য একটি কার্যকর পথনির্দেশ। যারা দায়িত্বে রয়েছেন, তারা যদি সততা, তাকওয়া ও দূরদৃষ্টি নিয়ে কাজ করেন, তবে সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করা সম্ভব। ইমাম আলী (আ.)-এর এই ঐতিহাসিক বার্তা আমাদের শেখায়—আল্লাহর নিয়মে নেতৃত্ব একটি পরীক্ষা, যেখানে সত্য, ন্যায় ও আত্মশুদ্ধিই সফলতার চাবিকাঠি। এই বার্তা আজও ইসলামী সমাজের জন্য এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা, যা স্থিতি, ন্যায়বিচার ও সঠিক নেতৃত্বের পথ দেখায়।

অনুবাদ: হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন ডক্টর মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha