ইরাকের এই ধর্মীয় গবেষক আযম আবুল হাসান ইরাকি হাওজা নিউজ এজেন্সি’র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, প্রাচীন ঐতিহাসিক ও হাদীস গ্রন্থ সমূহের ভিত্তিতে হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) ছিলেন ইসলামী সমাজের প্রথম সাহসী ব্যক্তিত্ব, যিনি প্রকাশ্য ও সক্রিয়ভাবে অবৈধ শাসনব্যবস্থার বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর এই অবস্থান কোনো ব্যক্তিগত প্রতিবাদ ছিল না; বরং তা ছিল ঐশীভাবে নির্ধারিত ইমামত ও খেলাফতের নীতির সুরক্ষায় এক ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন।
তিনি আরও বলেন, এই বিরোধিতা ছিল এক প্রকার বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক জিহাদ, যা খিলাফতের বিকৃতি ও আল্লাহ নির্ধারিত উত্তরাধিকারের বিকৃত ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল। হযরত ফাতিমা (সা.আ.) বিভিন্ন উপায়ে— যেমন জ্বলন্ত ভাষণে, কুরআনের আয়াত ও নবীজির (সা.) হাদীস উদ্ধৃত করে এবং বায়আত অস্বীকারের মাধ্যমে—প্রচলিত শাসন ব্যবস্থার মুখোমুখি হন।
এই গবেষক উল্লেখ করেন, যেমন তিনি নবীজির (সা.) জীবদ্দশায় কঠিন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক অবরোধ ও পরীক্ষার সময় তাঁর সাহচর্য ও সহায় ছিলেন, তেমনি নবীজির ইন্তেকালের পরও সেই জিহাদি চেতনা অব্যাহত রাখেন। তাঁর এই সংগ্রাম ছিল নবুয়তের ধারাবাহিকতা—যেখানে পূর্বে তিনি নবীর ব্যক্তিত্বের প্রতিরক্ষায় ছিলেন, আর পরে সত্য ধর্ম ও বৈধ নেতৃত্বের রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা নেন।
আযম আবুলহাসান ইরাকি বলেন, হযরত ফাতিমা (সা.আ.) “উম্মুল আইম্মাহ” তথা “ইমামদের জননী” ও “সুন্নতের বিশারদ” হিসেবে ইসলামী শাসনের পথ সংশোধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর ফাদাকের ভাষণ (খুতবা-ই-ফাদাক) এবং ইমাম আলি (আ.)-এর গুণাবলি বর্ণনা প্রকৃতপক্ষে সেই মৌলিক ইসলামী মূল্যবোধগুলোকেই পুনরুজ্জীবিত করেছিল, যা সাকীফার ঘটনাবলির মধ্যে ম্লান হয়ে গিয়েছিল।
তিনি বলেন, পবিত্র কুরআনের সূরা আলে ইমরানের ২০০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন—
«يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اصْبِرُوا وَصَابِرُوا وَرَابِطُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ»
হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ধারণ কর, প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলায় দৃঢ় থাক, প্রস্তুত ও সতর্ক অবস্থায় থাক, এবং আল্লাহকে ভয় কর—যাতে তোমরা সফল হতে পারো।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, এই আয়াত মুমিনদের তিন স্তরের প্রতিরোধ শিক্ষা দেয় “اصبروا” অর্থাৎ দুঃখ-কষ্ট ও নির্যাতনের মুখে ধৈর্যধারণ;
“صابروا” অর্থাৎ শত্রুর মোকাবিলায় সক্রিয় প্রতিরোধ;
এবং “رابطوا” অর্থাৎ ঈমানের সীমারক্ষা ও সর্বদা প্রস্তুত থাকা।
গবেষক বলেন, হযরত ফাতিমা (সা.আ.) ছিলেন এই আয়াতের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
তিনি “اصبروا”-এর পর্যায়ে পিতার মৃত্যু ও ফাদাক হরণের দুঃখে ধৈর্য ধারণ করেন;
“صابروا”-এর স্তরে অবৈধ খেলাফত ও নিজের অধিকার হরণের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অবস্থান নেন; আর “رابطوا”-এর পর্যায়ে তিনি ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ নীতিমূল—বেলায়াত (আলীর নেতৃত্ব)—এর প্রহরী হিসেবে দাঁড়ান।
শেষে তিনি বলেন, হযরত ফাতিমা যাহরার (সা.আ.) সকিফার খেলাফতের প্রতি অবস্থান কোনো ক্ষণস্থায়ী প্রতিবাদ ছিল না, বরং ছিল এক সুসংগঠিত ঐশী আন্দোলন, যা প্রকৃত মুহাম্মদী ইসলামকে সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছিল। তিনি তাঁর সমস্ত শক্তি ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে এমন এক চিরন্তন নারীর প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন, যিনি ধৈর্য, প্রতিরোধ ও জাগ্রত অবস্থানের মাধ্যমে সত্যের পক্ষে সংগ্রাম করেছেন।
সুতরাং, হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর জীবনদর্শন পবিত্র কুরআনের আয়াত (আলে ইমরান ৩:২০০)-এর বাস্তব প্রতিফলন— এক অনন্য ইতিহাস, যেখানে নারীর মর্যাদা, ঈমানের দৃঢ়তা এবং সত্য রক্ষার সংগ্রাম একই স্রোতে মিলিত হয়েছে।
সূত্রসমূহ:
১. কুরআন,
২. আযম আবুলহাসান ইরাকি, সাক্ষাৎকার, “হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন।
৩. হাদীস সূত্র: আল-কাফি, শায়খ আল-কুলাইনি, খণ্ড ২, অধ্যায় “الإمامة والفقه السياسي”।
৪. হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর জীবনচরিত ও সকিফা সংক্রান্ত ইতিহাসের জন্য প্রাথমিক উৎস: মুহাম্মদ বাগির ইবনে মাসউম, মাহাজির নাহজুল কোরআন, খণ্ড- ১।
আপনার কমেন্ট