বুধবার ৫ নভেম্বর ২০২৫ - ১২:৫২
হ্যালোইন— শুধু “মিষ্টি না দুষ্টুমি”, নাকি আধুনিক যুগের ধর্মীয় বিপথগামিতা?

প্রতি বছরের মতো এবারও অক্টোবরের শেষ প্রান্তে পশ্চিমা বিশ্বে জাঁকজমকভাবে পালিত হলো “হ্যালোইন”—কুমড়োর ভেতর মোমবাতির আলো, ভয়াল মুখোশ, কঙ্কাল, ডাইনী, ভূত ও শয়তানের সাজে রাস্তায় নামা মানুষের এক উন্মত্ত উৎসব। সর্বত্র শোনা যায় সেই শিশুসুলভ স্লোগান—“মিষ্টি না দুষ্টুমি?” (Trick or Treat?)।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: এটাই কি কেবল এক বিনোদনমূলক উৎসব? নাকি এর অন্তরালে রয়েছে এক গভীর আধ্যাত্মিক বিচ্যুতি, ধর্মীয় বিকৃতি ও শয়তানবাদী ভাবধারার বিস্তার?

উৎসব থেকে বিভ্রান্তি: হ্যালোইনের রূপান্তর
একসময় পশ্চিমা সমাজে হ্যালোইন ছিল প্রাচীন সেল্টিক “স্যামহেইন” (Samhain) উৎসবের স্মৃতি—যেখানে বিশ্বাস করা হতো, বছরের এই রাতে জীবিত ও মৃতদের জগতের মাঝে পর্দা পাতলা হয়ে যায়, আত্মারা ফিরে আসে পৃথিবীতে। পরবর্তীতে খ্রিষ্টানরা এ উৎসবের দিনটিকে “অল সেন্টস’ ডে”-এর (All Saints’ Day) আগের রাত হিসেবে গ্রহণ করে, মৃতদের স্মরণ ও প্রার্থনার মাধ্যমে একে ধর্মীয় ব্যাখ্যা দেয়।

কিন্তু আধুনিক যুগে সেই ধর্মীয় তাৎপর্য ক্রমে বিলীন হয়েছে। এখন হ্যালোইন পরিণত হয়েছে এক বাণিজ্যিক উৎসবে—যেখানে মৃত্যু, ভূত, জাদু, শয়তান ও রক্তের ভয়াবহ চিত্র ব্যবহার করা হয় শুধুই বিনোদনের নামে।

ক্যাথলিক সংবাদসংস্থা Zenit-ও একসময় বলেছিল, “হ্যালোইনকে ভয় না পেয়ে তার প্রকৃত অর্থ বোঝা দরকার—এটি ছিল এক ধর্মীয় উৎসব, যাকে এখন মুক্ত করতে হবে বাণিজ্যিকতা ও অন্ধকারাচ্ছন্ন গূঢ়চর্চার ছায়া থেকে।”

কিন্তু বাস্তবতা হলো, আজ হ্যালোইন গির্জা থেকে বেরিয়ে এসে স্কুল, টেলিভিশন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিশুদের মানসজগতে ঢুকে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি কিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও এটি “খেলা” বা “সংস্কৃতি”র নামে পালন করা হচ্ছে—যা গভীর উদ্বেগের বিষয়।

ধর্মীয় বিপথগামিতা ও গুপ্তবাদ
বহু ধর্মতাত্ত্বিক ও সমাজবিশ্লেষক হ্যালোইনকে এখন দেখছেন “ধর্মীয় বিচ্যুতি” ও “আধ্যাত্মিক বিভ্রান্তি” হিসেবে। তাদের মতে, এটি শয়তানবাদীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস, যা গূঢ়তন্ত্র (occultism) ও জাদুবিদ্যার প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে।

তারা বলেন, এটি আসলে এক “অশুচি মেসোনিক সংমিশ্রণ” (osceno sincretismo massonico) — যেখানে একদিকে মৃত্যু ও ভয়ের প্রতীক স্যামহেইন (Lord of Death)-কে পূজা করা হয়, আর অন্যদিকে সন্ত, শহীদ ও মৃতদের স্মরণ দিবসগুলোকে প্রান্তিক করে দেওয়া হয়।

ইতালির কিছু অঞ্চলে (যেমন এমিলিয়া রোমানিয়া) কিছু ধর্মীয় নেতা এমনকি হ্যালোইন উদযাপন নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন, কারণ তারা একে খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধের পরিপন্থী মনে করেন।

হ্যালোইন, বর্ণবাদ ও সাংস্কৃতিক আত্মসাৎ
আধুনিক হ্যালোইনের আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হলো তথাকথিত “blackface” প্রথা—যেখানে শ্বেতাঙ্গরা কালোদের অনুকরণে মুখে কালো রং মেখে বিনোদন পরিবেশন করে। এটি মূলত বর্ণবাদের সাংস্কৃতিক রূপ (cultural appropriation)।

ইতিহাসে দেখা গেছে, মার্কিন সমাজে এই প্রথার মাধ্যমে কালো মানুষদের অবমাননা করা হয়েছে—তাদের “অজ্ঞ, অলস ও অশিক্ষিত” হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। সাদা শিল্পীরা মুখে কালো রং মেখে নাটক, সংগীত ও বিনোদনে কৃষ্ণাঙ্গদের ব্যঙ্গ করত।

আজও সেই বিকৃত মানসিকতার রূপ দেখা যায় পপ সংস্কৃতিতে—যেখানে লেডি গাগা বা মাইলি সাইরাসের মতো তারকারা কালো নৃত্যশিল্পীদের ব্যবহার করেন যৌনতা ও বিকৃত বিনোদনের অংশ হিসেবে।

এভাবে হ্যালোইন হয়ে উঠেছে “কমলা আর কালোর উৎসব”—যা জনপ্রিয় সিরিজ Orange is the New Black-এর মতো এক ভয়াবহ মিশ্রণ: জেল, সহিংসতা, যৌনতা ও বিকৃত মুক্তচিন্তা।

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে হ্যালোইন
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে হ্যালোইনের মতো উৎসবের কোনো স্থান নেই। ইসলামে মৃত্যু ও মৃতের স্মরণ একটি পবিত্র বিষয়—যেখানে ভয়, বিকৃতি বা বিনোদনের স্থান নেই।

মৃতদের স্মরণ মুসলমানদের জন্য দোয়া, দান ও কবর জিয়ারতের মাধ্যমে করা হয়; শয়তান, জাদু বা ভয়ংকর রূপের মাধ্যমে নয়। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না; নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা আল-বাকারা, ২:১৬৮)

হ্যালোইন সংস্কৃতি আসলে সেই “শয়তানের পদাঙ্ক” অনুসরণের আধুনিক রূপ—যেখানে ভয়, অন্ধকার ও মৃত্যুর প্রতি বিকৃত আকর্ষণ সৃষ্টি করা হয়। ইসলামে এসব প্রতীক ও আচরণকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “যে জাতির অনুকরণ করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।” (আবু দাউদ)

অতএব, মুসলমানদের উচিত নয় পশ্চিমা এই শয়তানবাদী ও ভোগবাদী সংস্কৃতির অনুসরণ করা। বরং আমাদের উচিত নিজেদের ইসলামী ঐতিহ্য—মৃতদের জন্য দোয়া, দান-সদকা, কবর জিয়ারত ও আত্মার পবিত্রতার চর্চাকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা।

ইউরোপীয় ঐতিহ্য ও ইসলামী মূল্যবোধ
ইতালীয় ঐতিহ্যেও মৃতদের স্মরণে এক সময় “লেমুরিয়া উৎসব” পালিত হতো, যেখানে পরিবারপ্রধান মৃত আত্মাদের শান্তির জন্য পবিত্র বীজ উৎসর্গ করতেন। এটি ছিল আত্মীয়তা, স্মরণ ও দয়ার প্রতীক।

কিন্তু আজ সেই ইতিবাচক ঐতিহ্য হারিয়ে গিয়ে তার স্থানে এসেছে ভয়, রক্ত ও শয়তানের নাটক।

এ দৃশ্য আমাদের জন্যও সতর্কবার্তা। কারণ, যখন মুসলমান সমাজও পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণে লিপ্ত হয়—তখন আমাদের আত্মিক শূন্যতা, ঈমানের দুর্বলতা ও সাংস্কৃতিক পরাধীনতা আরও প্রকট হয়ে ওঠে।

হ্যালোইন কেবল “মিষ্টি না দুষ্টুমি”-র খেলা নয়; এটি এক সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক আগ্রাসনের অংশ, যা ধীরে ধীরে মানুষকে শয়তান, ভয় ও অন্ধকারের প্রতি আকৃষ্ট করছে।

ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয়—মৃত্যুকে ভয় নয়, বরং চিন্তা ও আত্মসমালোচনার উপলক্ষ হিসেবে গ্রহণ করতে; আত্মাকে শুদ্ধ করতে এবং পরকালের প্রস্তুতি নিতে।

অতএব, মুসলমানদের দায়িত্ব—এই ধরণের বিকৃত সংস্কৃতি থেকে নিজেদের পরিবার ও সমাজকে রক্ষা করা, সত্য, পবিত্রতা ও তাওহিদের আলোয় নিজেদের জীবন আলোকিত করা।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha