হাওজা নিউজ এজেন্সি: আজকের পৃথিবীতে ফেরাউনিজম শুধুই অতীতের গল্প নয়; এটি আধুনিক রূপে বিবর্তিত হয়েছে এবং এখনো মানবতার উপর তার ছায়া বিস্তার করছে। অতীতের ফেরাউনরা শারীরিক শৃঙ্খলে মানুষকে বন্দী করেছিল, কিন্তু আধুনিক ফেরাউনরা মানবতাকে বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলে দাসত্বে আবদ্ধ করছে। তারা চায় না মানুষ বুঝতে পারুক যে, মানব জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল ঐশী মুক্তি ও আত্মিক বিকাশ।
আধুনিক ফেরাউনরা কীভাবে এই দাসত্ব বজায় রাখে?
১. বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব: বৈশ্বিক মিডিয়া, নিয়ন্ত্রিত বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিকৃত মতাদর্শিক প্রবাহ মানুষের মনকে তাদের প্রকৃত লক্ষ্য থেকে বিভ্রান্ত করছে। মানুষের জীবনের প্রকৃত অর্থ অনুসন্ধানের পরিবর্তে তারা ক্ষণস্থায়ী ভোগ, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং কৃত্রিম পরিচয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে।
২. অর্থনৈতিক শোষণ: আধুনিক ফেেরাউনরা এমন আর্থিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করেছে, যা মানুষকে দাসত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ রাখে। সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা, ডলারের আধিপত্য, নিষেধাজ্ঞা ও নতুন উপনিবেশবাদী নীতিগুলো জাতিগুলোকে দাসত্বে আবদ্ধ করে রেখেছে, ঠিক যেমন ফেরাউন বনি ইসরাইলকে শ্রমিক ও দাস হিসেবে ব্যবহার করত।
৩. রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য: ইসলামী দেশগুলোতে পশ্চিমা সমর্থিত দলগুলো অভ্যন্তরীণ মুনাফিকের ভূমিকা পালন করে, যারা আধুনিক ফেরাউনের প্রতি আত্মসমর্পণকে প্রচার করে। তারা এই আত্মসমর্পণকে “আলোচনা”, “পারমাণবিক চুক্তি”, বা “গঠনমূলক সম্পৃক্ততা”র মতো শব্দে ঢেকে রাখে, কিন্তু বাস্তবে এটি বৈশ্বিক জালিমদের সামনে নতিস্বীকার ছাড়া আর কিছুই নয়।
ইহুদিরা, মুসলিম বিশ্বের বিশ্বাসঘাতক এবং আধুনিক ফেরাউনিজমের সেবক
যেমন কিছু বনি ইসরাইল, ফেরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরও মিশরের দাসত্বে ফিরে যেতে চেয়েছিল, তেমনি আজকের মুসলিম বিশ্বে কিছু বিশ্বাসঘাতক শাসক ও মুনাফিক গোষ্ঠী আধুনিক দাসত্বের শৃঙ্খলে ফিরে যেতে চায়।
১. ইসরাইল-সমর্থক আরব শাসকগোষ্ঠী, যেমন সৌদি রাজতন্ত্র ও কিছু উপসাগরীয় রাষ্ট্র, ইসরাইলি শাসন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আত্মসমর্পণের চুক্তি করেছে, যারা ঠিক সেই দুর্বল হৃদয়ের বনি ইসরাইলের ভূমিকা পালন করছে, যারা নিজেদের মর্যাদাকে ফেরাউনের টেবিলের টুকরোর জন্য বিনিময় করেছিল।
২. জায়নিস্ট শাসন হল আধুনিক ফেরাউনিজমের ধারাবাহিকতা, যারা ফিলিস্তিনিদের উপর অত্যাচার, গণহত্যা ও আঞ্চলিক সম্পদের দখলদারি চালিয়ে মুসলিম বিশ্বকে দাসত্বে আবদ্ধ রাখতে চায়। তারা প্রতিরোধ অক্ষকে সহ্য করতে পারে না, কারণ এটি মুক্তির প্রতীক।
৩. ইরানের অভ্যন্তরীণ মুনাফিকেরা, যারা প্রতিরোধের পক্ষে না দাঁড়িয়ে সবসময় আলোচনা, আপোষ ও শত্রুর সামনে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। তারা সেই দুর্বল বিশ্বাসের মানসিকতা বহন করে, যেমন বনি ইসরাইল ফিরআউনের শাসনে আরাম খুঁজেছিল—যে মানসিকতাকে ইমাম খোমেইনি (রহ.) “আমেরিকান ইসলাম” বলেছেন।
কেন আধুনিক ফেরাউনরা মানবতার আত্মিক বিকাশ মেনে নিতে পারে না?
হজরত মূসা (আ.)-এর সময় ফেরাউন মেনে নিতে পারেনি যে, মানুষ আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে তাদের প্রকৃত লক্ষ্য ও আত্মিক উচ্চতায় পৌঁছাবে। কুরআনে বলা হয়েছে: “আর সে তার জাতিকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছিল, তাদের একদলকে দুর্বল করেছিল, তাদের পুত্রদের হত্যা করত এবং নারীদের জীবিত রাখত। নিশ্চয়ই, সে ছিল দুরাচারীদের একজন।” [সূরা কাসাস: ৪]
আধুনিক ফেরাউনও একই পদ্ধতি অনুসরণ করে:
তারা “পুত্রদের হত্যা” করে, যুবকদের নৈতিক অবক্ষয়, মাদকাসক্তি, লক্ষ্যহীনতা ও অধঃপতনে ডুবিয়ে দিয়ে।
তারা নারীদের শোষণ ও বস্তুতে পরিণত করে, যাতে তারা আত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সুযোগ না পায় এবং ভোগবাদ ও মিডিয়া প্রচারণার উপকরণ হয়ে থাকে।
তারা সমাজকে শ্রেণিবিন্যাস করে, যাতে বিশ্বের ১% জনগোষ্ঠী সমস্ত সম্পদের নিয়ন্ত্রণ করে এবং বাকিরা অর্থনৈতিক দাসত্বে আবদ্ধ থাকে।
প্রতিরোধ অক্ষ: আধুনিক ফেরাউনিজমের জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ
প্রতিরোধ অক্ষ হজরত মূসা (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পথ অনুসরণ করে:
১. বৈশ্বিক উপনিবেশবাদ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে অবস্থান: যেমন মূসা (আ.) ফেরাউনের শাসন মেনে নেননি, প্রতিরোধ অক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও উপনিবেশবাদী শক্তির আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করছে।
২. প্রকৃত ইসলামী চেতনা ও মর্যাদার পুনর্জাগরণ: ইমাম হুসাইন (আ.) বলেছেন, “আমাদের কাছ থেকে অপমান ও লাঞ্ছনা দূরে থাক”—এই নীতিকে প্রতিরোধ অক্ষ অক্ষুণ্ণ রেখেছে, যা সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক।
৩. ইমাম মাহদি (আ.ফা.)-এর আগমনের ময়দান প্রস্তুত করা: যেমন মূসা (আ.) বনি ইসরাইলকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তেমনি প্রতিরোধ অক্ষ সত্যিকারের বিশ্বনায়কের আগমনের জন্য পথ প্রশস্ত করছে।
উপসংহার: আধুনিক ফেরাউনরা বুদ্ধিবৃত্তিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলে মানুষকে দাসত্বে আবদ্ধ করে রেখেছে।
মুসলিম বিশ্বের অভ্যন্তরীণ মুনাফিকরা এই আধুনিক ফেরাউনিজমের সেবক।
প্রতিরোধ অক্ষ হজরত মূসা (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পথ অনুসরণ করে অত্যাচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।
চূড়ান্ত লক্ষ্য হল ঐশী মুক্তি ও আত্মিক বিকাশ এবং ইমাম মাহদি (আ.জ.)-এর আগমনের জন্য প্রস্তুতি।
“আর যারা জুলুম করেছে তারা শীঘ্রই জানতে পারবে তারা কোন প্রত্যাবর্তনের দিকে ফিরে যাচ্ছে।” (সূরা শু'আরা: ২২৭)
সংগ্রহ ও অনুবাদ: জনাব আম্মার সাবিল
আপনার কমেন্ট