হাওজা নিউজ এজেন্সি: শিশুর মন এক নবগজানো বাগানের মতো—প্রতিটি প্রশ্নে একটি নতুন ডালপালা গজায়। সীমাহীন কৌতূহল ও সজীব কল্পনার শক্তিতে তারা দৃশ্যমান-অদৃশ্য সব কিছুর অর্থ ও ব্যাখ্যা খুঁজে ফেরে। অনেক সময় এসব সহজ-সরল প্রশ্নের পেছনে লুকিয়ে থাকে গভীর চিন্তা ও জটিল ধারণা বুঝার চেষ্টা।
যদি অভিভাবকরা ধৈর্য, সততা ও সম্মানের সাথে শিশুদের প্রশ্নের জবাব দেন, তবে তারা হবে সন্তানের চিন্তার সেরা সহযাত্রী।
শিশুর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ৭টি উপায়
১. আগে মনোযোগ দিয়ে শুনুন
সব প্রশ্নের উত্তর তাৎক্ষণিকভাবে দেওয়া দরকার নেই। অনেক সময় শিশুরা উত্তর নয়, বরং বোঝাপড়া ও মানসিক আশ্রয় খোঁজে। যেমন, যদি সে বলে: “আল্লাহ দয়ালু হলে যুদ্ধ হয় কেন?”— সঙ্গে সঙ্গে উত্তর না দিয়ে বলুন, “তোমার প্রশ্নটা চমৎকার! তুমি নিজে কী মনে করো?” এরপর মনোযোগ দিয়ে শুনুন, তার চিন্তার গভীরে কী আছে বুঝুন।
২. তাদের বাস্তব উদাহরণ দিন
যদি আপনার সন্তান ভিডিও গেম বা মোবাইলে সময় কাটায়, আপনি বলতে পারেন: “দেখেছো তো, যখন গেম হ্যাং করে তখন একজন প্রোগ্রামার এসে ঠিক করে? এই বিশাল জগতেরও একজন নির্মাতা আছেন। ঠিক যেমন গেমের উদ্দেশ্য থাকে, তেমনি জীবনেরও আছে।”
৩. ব্যঙ্গ বা অবমূল্যায়ন নয়
“তুমি ধর্ম নিয়ে কী বুঝবে?” কিংবা “এই প্রশ্নগুলো তোমার করার নয়” — এ ধরনের কথা শিশুকে আরও গুটিয়ে দেয় এবং সে ভবিষ্যতে প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকে।
৪. যদি না জানেন, তা স্বীকার করুন
যদি সে বলে, “কিছু মানুষ ধার্মিক না হয়েও অনেক সফল কেন?”— আর আপনি উত্তর না জানেন, বলুন: “ভালো প্রশ্ন। আমি এর সঠিক উত্তর জানিনা। চলো, একসাথে এর উত্তর খুঁজে দেখি।” এতে শিশুর মাঝে প্রশ্ন করার সাহস জন্মায়।
৫. সহজ ও নির্ভরযোগ্য উৎস ব্যবহার করুন
শিশুরা ছোট ছোট কথা ও চিত্রভিত্তিক উপস্থাপন পছন্দ করে। কঠিন কোনো প্রশ্নে দীর্ঘ বক্তৃতার বদলে একটি দুই মিনিটের বোধগম্য ভিডিও অধিক কার্যকর।
৬. ঘরকে নিরাপদ প্রশ্নোত্তরের পরিবেশে রূপ দিন
যদি সন্তান অনুভব করে যে প্রশ্ন করলে বকা খাবে, তাহলে সে অন্য কোথাও যাবে—যেখানে হয়তো ভুল তথ্য বা বিভ্রান্তিকর উত্তর পাবে।
৭. সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করুন
জটিল শব্দ, ধর্মতাত্ত্বিক পরিভাষা বা কঠিন ভাষা এড়িয়ে চলুন। এমনভাবে উত্তর দিন যাতে সে সহজে বুঝতে ও অনুভব করতে পারে।
মূল কৌশল: চিন্তা-উদ্দীপক প্রশ্নে উৎসাহ দেওয়া
অভিভাবকদের জন্য ৩টি কার্যকর কৌশল:
১. শিশুর জানা বিষয় জিজ্ঞাসা করুন: জানতে চান, সে বিষয়টি সম্পর্কে আগে থেকেই কী জানে।
২. চিন্তাভাবনায় উদ্বুদ্ধ করুন: প্রশ্ন করুন— “তুমি কী ভাবো?” “তোমার মতে কী হতে পারে?”
৩. ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি কল্পনা করান: উদাহরণ: শিশুর প্রশ্ন — “আকাশ কেন অন্ধকার হয়?”
এর জবাবে আগে বলুন:
– “আকাশ অন্ধকার হলে কী হয়?”
– “তখন আকাশে কী কী দেখা যায়?”
– “তুমি চাঁদ-তারা কখন দেখতে পাও?”
এইভাবে প্রশ্ন করে শিশুর চিন্তাভাবনা আরও গভীর করা যায়।
তড়িঘড়ি উত্তর দিলে সে কিছু শেখে না; বরং ভাবনার মাধ্যমে নিজে শিখলে সেটি তার মনে গেঁথে থাকে। এর ফলে বিশ্লেষণ ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা তৈরি হয়।
কিছু সাধারণ শিশুপ্রশ্ন ও তাদের উত্তর
১. “আল্লাহ কোথায়? আমি কেন তাঁকে দেখতে পাই না?”
উত্তর: “তুমি কি বাতাস দেখতে পাও? না, কিন্তু তুমি জানো বাতাস আছে, কারণ তুমি নিঃশ্বাস নিচ্ছো। আল্লাহও ঠিক তেমনই আছেন—তিনি সব সময় আছেন, যদিও চোখে দেখা যায় না। তিনি যেন এক আলো, যা পর্দার আড়ালে রয়েছে।”
২. “আল্লাহ দেখতে কেমন?”
উত্তর: “তিনি ভালোবাসা বা আনন্দের মতো—তাকে অনুভব করা যায়, কিন্তু দেখা যায় না। যদি তিনি মানুষের মতো হতেন, তাহলে সব জায়গায় একসাথে থাকতে পারতেন না!”
৩. “মা, আমরা কেন স্বপ্ন দেখি? স্বপ্ন কি সত্যি?”
উত্তর: “স্বপ্ন হলো আমাদের মস্তিষ্কের বানানো সিনেমার মতো—রাতে মস্তিষ্ক নিজের মতো করে গল্প বানায়। কিছু সময় তা মজার, কিছু সময় অদ্ভুত। সেগুলো বাস্তব নয়, তবে আমাদের মনের ভাব প্রকাশ পায়।”
উপসংহার: শিশুর প্রশ্ন তার চিন্তার দরজা। আপনি যদি সেই দরজায় শ্রদ্ধা, সময় ও আন্তরিকতার আলো ফেলতে পারেন, তবে সে শুধু সঠিক উত্তরই পাবে না—একজন ভাবুক, অনুসন্ধানী মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে।
আপনার কমেন্ট