শুক্রবার ২৫ জুলাই ২০২৫ - ১৫:০১
কারা আমাদের সম্মানের যোগ্য? হাদীসের আলোকে সম্মানের যোগ্য সাত শ্রেণি

ইসলামী হাদীস ও রেওয়ায়েতে শুধু আলেম নয়, সন্তান, প্রতিবেশী, অতিথি, সম্প্রদায়ের বয়োজ্যেষ্ঠ, এমনকি নিজের আত্মাও সম্মানের দাবিদার—একটি সম্মাননির্ভর সমাজই ঈমানদার সংস্কৃতির মূলভিত্তি। হযরত ফাতিমা মাসুমা (সা.)-এর জীবনের আলোকে এই নীতির বাস্তব রূপও আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে ওঠে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন রাফিয়ি এক বক্তৃতায় রেওয়ায়াতভিত্তিক বিভিন্ন ব্যক্তি ও শ্রেণির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টি তুলে ধরেছেন, যা আপনাদের জ্ঞানসন্ধানী পাঠকদের উদ্দেশ্যে উপস্থাপন করা হলো:

ইসলামী হাদীস ও রেওয়ায়েতসমূহে কিছু ব্যক্তি ও শ্রেণীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রতি বারবার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। "أَكرِموا" শব্দটি এসব রেওয়ায়েতে সম্মান, মর্যাদা দান ও সম্মান রক্ষা করার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি কেবল একটি ব্যক্তিগত আচরণ নয়, বরং একটি মুমিন সমাজের সাংস্কৃতিক কাঠামোর অংশ।

প্রথমত: আলেমদের সম্মান
হাদীসে বলা হয়েছে: «أَكرِموا العُلَماء— আলেমদের সম্মান করো।
আলেম বা দ্বীনী বিদ্বানদের সম্মান করা মানে তাদের কথায় কান দেওয়া, নাম ও মর্যাদার প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের সামনে দাঁড়িয়ে সম্মান জানানোর মতো কাজ অন্তর্ভুক্ত। আলেমদের অসম্মান, গীবত বা তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার একজন মানুষের জীবনে ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।

দ্বিতীয়ত: প্রতিবেশীর সম্মান
«أَكرِموا الجار» — প্রতিবেশীকে সম্মান করো।

প্রতিবেশীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মধ্যে রয়েছে— এমন কিছু না করা যা প্রতিবেশীর কষ্টের কারণ হয়, অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া, মৃত্যুবরণ করলে জানাজায় অংশগ্রহণ করা, বিপদে পড়লে সাহায্য করা, ইচ্ছেকৃতভাবে ঘর উঁচু করে তার আলো-হাওয়া বন্ধ না করা।

দুঃখজনকভাবে, বর্তমান শহর পরিকল্পনায় ইসলামি আদর্শ উপেক্ষিত হচ্ছে। ইসলাম প্রতিবেশীর প্রতি সম্মানকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক মূল্যবোধ হিসেবে উপস্থাপন করে।

তৃতীয়ত: সন্তানের সম্মান
«أَكرِموا أولادَكُم و أحسِنوا آدابَهُم یغفِر لَكُم» — তোমাদের সন্তানদের সম্মান করো এবং তাদেরকে উত্তম আদব-আচরণ শেখাও, তাতে আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করবেন।

সন্তানের জন্মের পর সুন্দর ও অর্থবহ নাম রাখা সম্মানের প্রথম ধাপ। হযরত রাসূল (সা.) বলেছেন, তাঁর কাছে প্রিয় নাম “হামযা”। আলেমরা বলেন, আহলে বাইতের (আ.) নামগুলো ঘরে বরকত আনে। সন্তানকে হারাম রুজি খাওয়ানো বা খারাপ আচরণ তার ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করে।

চতুর্থত: অতিথির সম্মান
«الضیف دليل الجنة» — অতিথি জান্নাতের পথপ্রদর্শক।

আরও আছে: «إذا أرادَ اللهُ بعبدٍ خیرًا، أهدی إلیه ضیفًا» — আল্লাহ যখন বান্দার জন্য মঙ্গল চান, তখন তাঁকে একজন অতিথি দেন।

অতিথি কল্যাণ ও বরকতের বাহক। আমিরুল মু’মিনিন (আ.) একবার সাতদিন অতিথি না আসায় উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। হাদীসের আলোকে বোঝা যায়, অতিথি আল্লাহর পক্ষ থেকে একরকম পুরস্কার।

পঞ্চমত: সম্প্রদায়ের বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান
«أكرِموا شریفَ كلِّ قوم» — প্রত্যেক সম্প্রদায়ের সম্মানিত ব্যক্তিকে সম্মান করো।

রাসূল (সা.) হাতেম তাইয়ের কন্যাকে তার পিতার সম্মানের কারণে মুক্তি দিয়েছিলেন, যদিও হাতেম মুসলমান ছিলেন না। এটি দেখায়, সম্মান একটি চারিত্রিক গুণ যা ঈমানের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হলেও মূল্যবান।

ষষ্ঠত: নিজের (নফসের) সম্মান
«أكرِموا أنفسَكُم» — নিজের সম্মান রক্ষা করো।

আত্মহত্যা, মাদকাসক্তি, নিজের দেহকে ক্ষতি করা — এসবই আত্মসম্মানহানিকর। কুরআনে আল্লাহ বলেন: «و لقد كرمنا بني آدم» — আমি আদম সন্তানের মর্যাদা দান করেছি। তাই নিজের প্রতি সম্মান প্রদর্শনও একটি ধর্মীয় দায়িত্ব।

সপ্তমত: ইমামজাদাদের সম্মান
যেসব ইমামজাদা তথা আওলাদে রাসুলের (সা.) ইতিহাস কিছুটা অস্পষ্ট, তাদের জন্যও সম্মানসূচক স্মরণ বা দিন নির্ধারণ করা যায়। যেমন হযরত ফাতিমা মাসুমা (সা.আ.)-এর জন্মদিন ১লা জিলক্বদ পালন করা হয়। এমনকি অজ্ঞাত তারিখের ইমামজাদাদের ক্ষেত্রেও ভক্তিভরে তাঁদের স্মরণ করা ইসলামী সংস্কৃতির অংশ।

বিশেষত: হযরত ফাতিমা মাসুমা (সা.)-এর সম্মান
ইমাম রেযা (আ.) বলেছেন: “আমাদের একজনের কবর তোমাদের কাছে আছে; তার মর্যাদা রক্ষা করো।” তিনি আরও বলেন, “যে তাঁকে যিয়ারত করবে, সে যেন আমাকেই যিয়ারত করল।”

মরহুম আয়াতুল্লাহ মারআশি নাজাফি বলেন, তিনি ৬৯ বছর ধরে প্রতিদিন প্রথম যিয়ারতকারী ছিলেন। আর্থিক সংকটে তিনি যখন তাঁর অবস্থার কথা হযরত মাসুমা (সা.আ.)-কে জানালেন, তার পরেই তিনি বাড়ি কেনার সুযোগ পান। এটি হযরতের কেরামতের একটি উদাহরণ।

হযরত ফাতিমা মাসুমা (সা.) থেকে আমরা যা শিখতে পারি: চরম পবিত্রতা (আবেদা, আফিফা), হিজাব ও লজ্জাশীলতা, আল্লাহর এবাদতে নিজেকে নিয়োজিত রাখা।

হাদীস অনুযায়ী, তিনি কেবল ১৭ দিন কোমে ছিলেন এবং এই সময়টিতে সর্বদা ইবাদতে নিয়োজিত ছিলেন।

সমাজে হিজাব ও ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষার গুরুত্ব

আজ হিজাব একটি সামাজিক ইস্যু। কিছু মানুষ বলে, দেশে তো অনেক সমস্যাই আছে—ঘুষ, দারিদ্র্য, দুর্নীতি। কিন্তু হিজাব সামাজিকভাবে দৃশ্যমান এক সংকট, যা সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়।

কোম শহরের ধর্মীয় মর্যাদা রক্ষা এবং ইসলামী মূল্যবোধ সংরক্ষণ করাই হচ্ছে হযরত ফাতিমা মাসুমা (সা.)-এর প্রকৃত সম্মান প্রদর্শন। কেবল ফুল হাতে নেওয়া, শরবত বিতরণ — ভালো কাজ হলেও যথেষ্ট নয়। প্রকৃত সম্মান হলো চর্চা, আত্মসংযম ও ইসলামী সংস্কৃতির বাস্তব প্রয়োগ।

শেষকথা: ইসলামী প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব

ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক শালীনতা রক্ষা করলে একমাত্র আমরা হযরত ফাতিমা মাসুমা (সা.)-এর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারব, আর এটিই ইসলামী সমাজের সাংস্কৃতিক ভিত্তি মজবুত করবে।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha