হাওজা নিউজ এজেন্সি: হুজ্জাতুল ইসলাম আহমাদ আবেদিবলেন, “শিয়া মতবাদের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্বের পেছনে একটি বড় কারণ হলো শোকানুষ্ঠানগুলো। ইতিহাসে বহুবার এগুলোকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু তারা সফল হতে পারেনি।”
আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “আব্বাসি খলিফা মুতাওয়াক্কিলের শাসনামলে ছিল শিয়াদের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময়। তবুও ঐ সময়ে পবিত্র ইমামগণ (আ.) তাঁদের অনুসারীদেরকে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শোক পালন ও তাঁর জিয়ারতের প্রতি উৎসাহিত করতেন।”
তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “আজকাল শোকানুষ্ঠানগুলোতে মূলত আহলে বাইত (আ.)-এর ওপর জুলুমকেই অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করা হয়—যা সত্য হলেও—এর পাশাপাশি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেন আড়ালে চলে যাচ্ছে, তা হলো জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।”
আবেদি স্পষ্ট করে বলেন, “ইমাম হুসাইন (আ.) মূলত ও সর্বাগ্রে জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং মজলুমের পক্ষে কণ্ঠস্বর তোলার জন্যই কিয়াম করেছিলেন। আমাদেরও প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত জালিমের বিরোধিতা এবং মজলুমের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ, এমনকি সেই মজলুম যদি অমুসলিম, ইহুদি, খ্রিষ্টান কিংবা ধর্মহীনও হন।”
তিনি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ঐতিহাসিক বক্তব্য উল্লেখ করে বলেন, “কারবালার প্রান্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘যদি তোমাদের মধ্যে দ্বীন না থাকে, তাহলে অন্তত মানবিকতা ও মুক্তচিন্তার অধিকারী হও।’ আমাদের ধর্মীয় নেতারাও যুগে যুগে এ শিক্ষাকেই বাস্তব করে তুলেছেন। ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে, আলেমগণ কোনো ইহুদিকেও যদি জুলুমের শিকার হতে দেখতেন, তার পক্ষেও রুখে দাঁড়াতেন।”
আবেদি আরও বলেন, “কুরআনও আমাদেরকে মজলুমের সাহায্যে এগিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছে। অতএব, ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আমাদের দাঁড়ানো একদিকে একটি ধর্মীয় দায়িত্ব, কারণ তারা মুসলমানও বটে; তবে এর বাইরেও, কেউ যদি মজলুম হয়—ধর্ম থাকুক বা না থাকুক—তাকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। এমনকি কোনো পশু যদি অবিচারের শিকার হয়, তাতেও আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে।”
তিনি একটি ঘটনা উল্লেখ করেন, “জঙ্গে সিফফিনের পর যখন তাঁবুগুলো গুটানো হচ্ছিল, তখন হযরত আলী (আ.) দেখলেন, একটি কবুতর একটি তাঁবুর মাথায় বাসা বেঁধেছে। তিনি বললেন, ‘এই তাঁবুটি সরাবে না, কারণ এতে একটি প্রাণীর আশ্রয়স্থল রয়েছে।’ এটি ছিল আহলে বাইতের শিক্ষা—মজলুম যেই হোক, তার পক্ষেই দাঁড়াও।”
আবেদি বলেন, “ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কিয়ামের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মজলুমদের নিরাপত্তা ও আশ্রয় নিশ্চিত করা। মূল সমস্যা শুধু এ নয় যে ইয়াজিদ অবৈধভাবে শাসনক্ষমতা দখল করেছে, বা সে মদ্যপান করে, নামাজ পড়ে না কিংবা পশু-পাখির সঙ্গে খেলাধুলা করে। এসবও অপরাধ হলেও সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল, তার আচরণ ছিল ফেরাউনের চেয়েও অন্যায়পূর্ণ—এমনকি অনেক সুন্নি আলেমও তা স্বীকার করেছেন।”
তিনি বলেন, “ফেরাউন সাত শত বছর ধরে নারীদের পেট চিরে সন্তান হত্যা করত, হীরাম গড়ার সময় হাজারো মানুষকে পাথরের নিচে পিষে মারত—তবুও বলা হয়, সে ন্যূনতম বিচারবোধ রাখত; কিন্তু ইয়াজিদের সময় ন্যায়বিচারের অস্তিত্বই ছিল না। তাই ইমাম হুসাইন (আ.) কিয়াম করেছিলেন।”
তিনি যোগ করেন, “ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শোকানুষ্ঠান জীবিত রাখার মানেই হলো—মজলুমদের পক্ষে লড়াইয়ের চেতনাকে জীবিত রাখা।”
আবেদি জোর দিয়ে বলেন, “যদি কোনো মুসলমান জুলুম করে, তার বিরুদ্ধেও আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে; আর কেউ যদি অধর্মী হয় কিন্তু জুলুমের শিকার হয়, তবুও তাকে রক্ষা করতে হবে। কারণ সকল নবী-রাসূল এসেছিলেন মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও জুলুমবিরোধী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য।”
তিনি আরও বলেন, “হুসাইনি শোকানুষ্ঠানের মূল শিক্ষা হলো স্বাধীনচিন্তা, আত্মোৎসর্গ, সাহস, নৈতিকতার পক্ষে আত্মত্যাগ—এই মানসিকতা গড়ে তোলাই এর লক্ষ্য। আসলেই, ইমাম হুসাইন (আ.) ও জয়নাব কুবরা (সা.আ.) আমাদের শিক্ষা দেন যে, সমাজে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “যদি কেউ শোকানুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সেলফি তোলে, বুকে আঘাত করে, কিন্তু পরক্ষণেই জনগণের হক নষ্ট করে—তাহলে সে প্রকৃত আশুরার চেতনাকে উপলব্ধি করেনি।”
সবশেষে হুজ্জাতুল ইসলাম আবেদি বলেন, “আসল শোকানুষ্ঠান হলো ন্যায়বিচারমূলক আচরণ—যে ব্যক্তি বিনা কারণে কোনো পশুর গায়ে পা দিয়ে তাকে আঘাত করে, মানুষের অধিকার হরণ করে, অধীনস্তদের সালামের উত্তর দেয় না, কর্মঘণ্টা নষ্ট করে কিংবা সাধারণ মানুষকে অহেতুক অপেক্ষায় রাখে—সে যতই বুকে আঘাত করুক, বাস্তবে সে শোকানুষ্ঠান থেকে বহু দূরে। কারণ হুসাইনি শোকানুষ্ঠানের মূল কথা হলো, যে-ই হোক, যে অবস্থায়ই থাকুক, মজলুমের পাশে দাঁড়াও।”
আপনার কমেন্ট