হাওজা নিউজ এজেন্সি: বিশ্বখ্যাত আরেফ ও দার্শনিক, মরহুম আয়াতুল্লাহ হাসানজাদা আমুলি (রহ.) এক নৈতিক পাঠে “হযরত মাসুমা (সা.)-এর আধ্যাত্মিক স্থান” প্রসঙ্গে বলেন, প্রায় সব সময় — বরং বলা চলে সবসময়ই — যখনই আমি হযরত মাসুমা (সা.)-এর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে কোমে আসি, আমার হৃদয় গভীর এক অনুভূতিতে ভরে যায়। এর সাক্ষী স্বয়ং সেই মহীয়সী নারীর পবিত্র আত্মা। এমনভাবে প্রভাবিত হই যে, দরজা-দেয়াল পর্যন্ত চুম্বন করি এবং নিচু স্বরে এই অর্থবহ কবিতাটি পড়ি:
أُقَبِّلُ أَرضًا صارَ فیها جِمالُها
فَکَیفَ بِدارٍ دارَ فیها جَمالُها
“আমি সেই মাটিকে চুম্বন করি, যেখানে তাঁর উট পদচারণা করেছে; তবে যে ঘরে স্বয়ং তিনি অবস্থান করেছেন, সেই ঘরকে আমি কীভাবে চুম্বন না করি?”
[এখানে "جمال" শব্দটি আরবি কাব্যভাষায় উটের প্রতীক হলেও, আধ্যাত্মিক প্রসঙ্গে এটি “সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি” বা নির্দিষ্ট সম্মানিত ব্যক্তিত্বের উপমা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই হযরত মাসুমা (সা.আ.)-এর প্রসঙ্গে এটি তাঁর মহিমা ও মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে।]
এই কবিতাটি ভালোবাসায় পূর্ণ হৃদয়ে পড়ে আমি আরজ করি: “বিবি জান! এখানে আমি কেবল জিহ্বায় নয়, হৃদয়ের ভাষায়ও কথা বলি। কখনো কখনো সর্বোচ্চ ভক্তি বজায় রেখেই আল্লাহর সাথে স্নিগ্ধ মজাও করি। বলি — হে প্রভু! এই কাজে তুমি সত্যিই অনন্য সৃষ্টি করেছো। এখানে কোনো অভিযোগ বা আপত্তির স্থানই রাখোনি; বরং প্রশংসাই প্রাপ্য।”
অর্থাৎ, গভীর ভালোবাসায় আল্লাহর সাথে মুনাজাত করি এবং সরল ভাষায় বলি — “হে প্রভু! তুমি হযরত মাসুমা (সা.আ.)-কে সৃষ্টি করেছো এবং এই অল্প বয়সে তাঁকে যে পূর্ণতা দান করেছো, তা সত্যিই এক মহৎ ও শ্রেষ্ঠ কাজ।”
হযরত মাসুমা (সা.আ.) উনিশ বছর বয়সে কোমে ইন্তেকাল করেন। তাঁর সম্মান ও মহত্ত্ব কেবল এই কারণে নয় যে, তিনি আহলে বাইতের (আ.) সপ্তম ইমামের কন্যা, অষ্টম ইমামের বোন এবং ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর ফুফু। যদিও এই সম্পর্কগুলো নিজ জায়গায় অত্যন্ত মূল্যবান, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব এ সম্পর্কের সীমা অতিক্রম করেছে।
ইমাম মুসা কাযিম (আ.)-এর সন্তানদের মধ্যে দু’জন বিশেষভাবে উজ্জ্বল ছিলেন:
প্রথমত — আল্লাহর হুজ্জাত, ইমাম রেজা (আ.)— যিনি ছিলেন মাসূম ও ইমাম।
দ্বিতীয়ত— এই উনিশ বছরের কন্যা, হযরত মাসুমা (সা.আ.) — যিনি প্রাকৃতিক মেধা, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও বিশেষ প্রজ্ঞায় এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। অল্প বয়সেই এমন মর্যাদা অর্জন করেন যে আজও অসংখ্য হৃদয়কে তাঁর দিকে আকৃষ্ট করছে।
আমাদের একজন সম্মানিত শিক্ষক (আল্লাহ তাঁকে রহম করুন)— জনাব সাইয়্যেদ মেহদী কাজী (রহ.), যিনি মহান আরেফ আয়াতুল্লাহ হাজ্ব সাইয়্যেদ আলী কাজী তাবরিজির পুত্র, প্রায়ই তাঁর বোন সম্পর্কে গভীর শ্রদ্ধার সাথে কথা বলতেন। তাঁর পিতা আয়াতুল্লাহ কাজী ছিলেন সেইর-ও-সুলুক ও ইলাহী মাআরিফের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব, অসংখ্য বড় আলেমের শিক্ষক, আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা ও কাশফ-মুশাহিদায় বিরল প্রতিভা।
জনাব সাইয়্যেদ মেহদী কাজী, যিনি নিজেও আমাদের বিভিন্ন ইসলামী বিদ্যায় শিক্ষক ছিলেন, মাঝে মাঝে মানব সেইর-ও-সুলুক ও আধ্যাত্মিক মর্যাদার প্রসঙ্গে বলতেন: “হাজ্ব আকা! আমাদের পিতার সন্তানদের মধ্যে এই বোনটি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা।”
যদিও তিনি নিজেও কাশফ-মুশাহিদার অধিকারী ছিলেন এবং মাঝে মাঝে নিজের কিছু আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা আমাকে বলতেন— যেগুলো আমার কাছে লিখিত আকারে সংরক্ষিত আছে এবং সুযোগ পেলে হয়তো কোনোদিন একটি রিসালা বা বই আকারে প্রকাশ করবো— তবুও তিনি সর্বদা জোর দিয়ে বলতেন: “আমাদের সেই বোনটি ছিল এক বিস্ময়।” এরপর তিনি যোগ করতেন: “আধ্যাত্মিক পথচলায় নারী-পুরুষের কোনো ভেদাভেদ নেই; চেষ্টা তোমার, আর বরকত আল্লাহর।”
হযরত মাসুমা (সা.আ.)-এর জীবন আমাদের শেখায় যে আধ্যাত্মিক মহিমা বংশগৌরবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা নিহিত রয়েছে জ্ঞান, ঈমান ও ঈশ্বরপ্রদত্ত অন্তর্দৃষ্টির আলোয়। তাঁর জীবনসংক্ষিপ্ত হলেও, প্রভাব অনন্ত—যা যুগে যুগে ভক্ত হৃদয়কে আলোকিত করে যাবে।
আপনার কমেন্ট