রবিবার ৩১ আগস্ট ২০২৫ - ১১:৫৬
ইসলামি উলামাদের ঐতিহাসিক আহ্বান: গাজার পক্ষে বিশ্বব্যাপী ঐক্য গড়ে তোলার তাগিদ

ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক আয়া সোফিয়া মসজিদে সমাপ্ত হলো আন্তর্জাতিক সম্মেলন “ইসলামি ও মানবিক দায়িত্ব; গাজা”। এতে ৫০টি দেশের ১৫০ জন বিশিষ্ট ইসলামি আলেম অংশ নেন। সম্মেলন শেষে জারি করা ঘোষণায় গাজায় চলমান গণহত্যা ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে একটি সর্বজনীন ইসলামি-মানবিক ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ২২–২৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে একাধিক কর্মশালা ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় এবং তা শেষ হয় জুমার নামাজের মাধ্যমে।

সম্মেলনের সূচনা ও প্রেক্ষাপট
তুরস্কের ডায়ানেত (ধর্ম বিষয়ক দপ্তর)-এর প্রধান আলী এরবাস শুক্রবার নামাজের পর আয়াসোফিয়া মসজিদের সামনে এক ভাষণে জানান যে, গাজা প্রসঙ্গে করণীয় নির্ধারণে ইস্তাম্বুলে এ সম্মেলন আয়োজন করা হয়।

এরবাস স্মরণ করিয়ে দেন যে, সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছিল ইস্তাম্বুলের আইয়ুব সুলতান মসজিদে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে। তিনি বলেন, “গাজার বিরুদ্ধে ইসরাইলি দখলদারদের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকলেও বিশ্বের কিছু সরকার যেন তাদের হাতে বন্দি হয়ে পড়েছে। তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হত্যাকারীদের সহায়তা করছে। অল্পসংখ্যক একদল বিদ্রোহী ও বিপথগামী শক্তি সমগ্র বিশ্বকে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু ফিলিস্তিনের সাহসী ও ঈমানদার জনগণ, হাতে সীমিত উপকরণ থাকা সত্ত্বেও, পূর্ণ আস্থা ও দৃঢ়তায় প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করা এবং গণহত্যা বন্ধের জন্য প্রচেষ্টা চালানো ধর্ম, বর্ণ, মত বা সংস্কৃতির ঊর্ধ্বে গিয়ে একটি মানবিক ও নৈতিক দায়িত্ব।”

তিনি আরও জোর দিয়ে বলেন, “গাজা মুসলমানদের জন্য বিশ্বাস ও ঈমানের ইস্যু। নির্যাতনের সামনে নির্লিপ্ত থাকা মানে হলো দখলদারদের সহযোগিতা করা, যা শরিয়ত অনুযায়ী হারাম। তাই প্রত্যেককে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের সবার কর্তব্য হলো ইসরাইলি দখলদারদের পণ্য ও স্বার্থ বর্জন করা।”

সম্মেলনের সমাপনী ঘোষণা
সম্মেলনের সমাপনী বিবৃতি পাঠ করেন ইসলামি উলামা ফাউন্ডেশনের সভাপতি প্রফেসর ড. নাসরুল্লাহ হাজি মুস্তাফি ওগলু। তিনি গাজার চলমান হত্যাযজ্ঞ, মানবতা ও পবিত্র স্থানসমূহের অবমাননা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের নীরবতা এবং কিছু আঞ্চলিক পক্ষের “গ্রেটার ইসরাইল প্রকল্প”-এ সহযোগিতার নিন্দা জানান।

তিনি বলেন, “এই সম্মেলন মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় ও মানবিক দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে আহ্বান করা হয়েছে। এতে গাজায় হামলা বন্ধ এবং মানবিক সহায়তার পথ উন্মুক্ত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। সম্মেলন জোর দিয়েছে যে, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও দখলদারিত্ব ঠেকাতে এক ইসলামি-মানবিক ঐক্যের বিকাশ অপরিহার্য।”

বিবৃতিতে বলা হয়:
▫️ফিলিস্তিনি জনগণ বৈধ উপায়ে, এমনকি সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমেও, দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার অধিকার রাখে।
▫️উম্মাহর সব রূপের জিহাদে অংশগ্রহণ জরুরি।
▫️গাজার স্থল, নৌ ও আকাশ অবরোধ ভাঙতে তাৎক্ষণিক ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক।
▫️সীমান্তবর্তী দেশগুলোর জন্য সব সীমান্ত গেট খোলা জরুরি দায়িত্ব।
▫️“ফ্লোটিলা অব ফ্রিডম” বা স্বাধীনতার নৌবহর আরও জাহাজ দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে।

সম্মেলন গাজার সংগ্রামী জনগণের পাশে দাঁড়ানো এবং সব ধরনের জনসাধারণের উদ্যোগ ও আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপকে পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করে।

অর্থনৈতিক সহায়তার প্রস্তাব
সম্মেলনে আলেমরা আহ্বান জানান,
▫️মুসলিম দেশগুলো একটি ওয়াকফ তহবিল গঠন করবে।
▫️অর্থনৈতিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এর পেছনে সক্রিয় করতে হবে।
▫️বার্ষিক মুনাফার অন্তত ২% গাজার সহায়তা ও পুনর্গঠনের জন্য ব্যয় করতে হবে।

এই প্রক্রিয়া আইনি ও স্বচ্ছ ব্যবস্থার মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে, যাতে টেকসই সহায়তা ও প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ানো যায়।

এছাড়া গাজার পুনর্গঠন, শান্তি ও স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনা মুসলিম ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষভাবে একটি মানবিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

দখলদার ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান
বিবৃতিতে সব সরকার, বিশেষত ইসলামি দেশগুলোকে আহ্বান জানানো হয়—
▫️ইসরাইল ও তার মিত্রদের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সব সম্পর্ক অবিলম্বে ও সম্পূর্ণভাবে ছিন্ন করতে হবে।
▫️দখলদারদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য ক্রয় শরিয়ত অনুযায়ী হারাম।

প্রতিরোধের স্বার্থে এই বর্জন ও অবরোধের ফতোয়া প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয়েছে, যা ইসলামি ফিকহের মৌলিক নীতি—মজলুমকে সহায়তা করা এবং জালেমকে ঠেকানোর ওপর প্রতিষ্ঠিত।

আন্তর্জাতিক বিচার ও ন্যায়বিচারের দাবি
সম্মেলন জোর দিয়ে বলেছে—
▫️আন্তর্জাতিক আদালতগুলোর রায় বাস্তবায়ন করতে হবে।
▫️গাজায় গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িতদের অবিলম্বে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
▫️ইসলামি ও স্বাধীন দেশগুলো নিজেদের দেশে বিশেষ আদালত গঠন করে এই অপরাধীদের বিচার করতে পারে।
▫️খ্রিস্টান, ক্যাথলিক ও প্রাচ্য-পাশ্চাত্য চার্চসমূহ এবং অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকেও গাজার গণহত্যার বিরুদ্ধে মানবিক অবস্থান নিতে আহ্বান জানানো হয়েছে।

ঐতিহাসিক আহ্বান
বিবৃতির শেষাংশে বলা হয়: “গাজায় গণহত্যা বন্ধ, নিরীহ মানুষের জীবন রক্ষা এবং দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবানে এই ঐতিহাসিক সম্মেলন। মুসলিম সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সমর্থকদের চাপে রাখতে হবে যাতে যুদ্ধ বন্ধ হয়। এই সম্মেলন মুসলিম উম্মাহর স্মৃতিতে ঐক্যের আহ্বান হিসেবে অম্লান থাকবে।”

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha