বৃহস্পতিবার ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ - ০৯:১৩
স্বর্গের একাংশ যেন এখানেই” – হজ্ব সফরনামায় রাসূল (সা.)-এর রওজা জিয়ারতের অভিজ্ঞতা

হজ্ব সফরনামার অন্যতম হৃদয়স্পর্শী অংশ হলো মদিনা মুনাওয়ারায় পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারতের মুহূর্ত। যারা এ সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, তারা তাঁদের লেখনীতে সেই আধ্যাত্মিক অনুভূতিগুলোকে অমর করে রেখেছেন।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: হজ্ব সফরনামা কেবল ভ্রমণকাহিনি নয়; এগুলো পৃথিবীর পবিত্রতম স্থানগুলোর সৌরভ, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে দাঁড়ানোর অবর্ণনীয় আবেগের দলিল। এই বর্ণনাগুলো পাঠকের মনে আকাঙ্ক্ষা ও মমতার গভীর স্রোত জাগিয়ে তোলে।

জালাল আল-আহমাদের 
খ্যাতনামা ইরানি সাহিত্যিক জালাল আল-আহমাদ ১৯৬৪ সালে হজ্ব পালনের সৌভাগ্য লাভ করেন এবং তাঁর অভিজ্ঞতা “খাসি দর মীকাত” গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। তিনি লেখেন— “সকালবেলা যখন বললাম ‘السلام علیک ایها النبی’, হঠাৎ এক অদ্ভুত শিহরণে কেঁপে উঠলাম। চোখের সামনে রওজা মুবারক, মানুষ ভিড় করে সালাম দিচ্ছে, রওজা চুম্বন করছে, আর শৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা অবিরাম তাগাদা দিচ্ছে। হঠাৎ চোখে পানি চলে এল, আমি মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলাম।”

তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, পবিত্র মক্কা ও মদিনা আন্তর্জাতিক ইসলামী তত্ত্বাবধানে থাকা উচিত, যাতে সব মুসলমান নির্ভয়ে, মর্যাদার সঙ্গে জিয়ারত করতে পারে।

আয়াতুল্লাহ লুৎফুল্লাহ সাফি গুলপয়গনির হজ্ব স্মৃতিকথা
১৯৮২ সালের হজ্বে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন— জেদ্দা থেকে মদিনার পথে রওজা মোবারক জিয়ারতের আকাঙ্ক্ষা এত প্রবল হয় যে প্রতিটি মুহূর্ত যেন দীর্ঘ হয়ে ওঠে। সময় যত ঘনিয়ে আসে, ততই হৃদয়ে উচ্ছ্বাস বাড়ে। কেউ আনন্দে কাঁদেন, কেউ কবিতা ও দরুদে রাসূল (সা.)-কে স্মরণ করেন, কেউ নীরবে আবেগ চেপে রাখেন, আবার কেউ আপনজনের কথা মনে করে অশ্রুসিক্ত হন।

মদিনায় পৌঁছে, সব যাত্রী সমস্বরে দরুদ ও সালাম পাঠ করেন। লেখক লিখেছেন— “যদি সম্ভব হতো, আমি মাথা দিয়ে এগিয়ে এই পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করতাম। যেন কেবল হাঁটা নয়, শ্রদ্ধাভরে মাথা নত করে প্রবেশ করাই এখানে প্রাপ্য।”

তিনি বলেন, রওজার সামনে দাঁড়ালে মানুষ স্বভাবতই বিনম্র হয়ে যায়। “যিনি ইতিহাসকে বদলে দিয়েছেন, চৌদ্দশ বছর ধরে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে শাসন করছেন, তাঁকে স্মরণ করলে হৃদয় না চাইলেও শ্রদ্ধায় নত হয়ে যায়।”

হেদায়াতুল্লাহ বেহবুদী
তিনি লিখেছেন: “দুপুরের পর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রওজার দিকে এগোলাম। সবুজ গম্বুজ দেখতে পেলাম। ভেতরে প্রবেশ করে দেখি লালচে রঙের অসংখ্য স্তম্ভ। মনে হলো রওজাটা কোথায়? চারদিকে ঘেরাও করা। পুলিশ কঠোরভাবে পাহারা দিচ্ছে। হাত বাড়ালে সরিয়ে দেয়, উঁচু স্বরে দরুদ পড়লেও চুপ করায়। যদি না জানতাম রাসুলুল্লাহ (সা.) সত্যিই এখানে সমাধিস্থ, তবে হয়তো এটাকে মন্দির ভেবে ভুল করতাম। কিন্তু ইরানি হাজিদের কান্না ও আবেগ মনে করিয়ে দিল, আমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছি।”

মোহাম্মদ নাসেরি
তিনি লিখেছেন: “মদিনার কাছে এলেই মনে হয় হৃদয় বেরিয়ে আসবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) যে পথ ধরে হেঁটেছিলেন সেই ভূমি দ্রুত পেরিয়ে যেতে মন চায় না। সহযাত্রীদের মুখে মসজিদে নববীতে প্রবেশের আদব শুনতে শুনতে দূর থেকে মদিনা দেখা যায়। হৃদয় উত্তেজনায় ফেটে পড়ে। শব্দে প্রকাশ করা যায় না।”

জাওয়াদ মুহাক্কিক
তিনি লিখেছেন: “এটি কেবল একটি মসজিদ নয়, বরং সরাসরি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাক্ষাৎ। এই সাক্ষাৎ মানুষকে কাঁপিয়ে দেয়। মসজিদে প্রবেশ করে মনে হয় পুরো মদিনাই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ঘর। প্রতিটি ইট, প্রতিটি পাথর ইতিহাসের সাক্ষী। চোখ বন্ধ করলে এখনও শোনা যায় সাহাবাদের কণ্ঠস্বর, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পদচারণা।”

এই সফরনামাগুলো কেবল ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ নয়, বরং মদিনার আবেগময় সৌন্দর্যের এক সাহিত্যিক প্রতিচ্ছবি। এগুলো প্রতিটি পাঠককে মনে মনে সেই পবিত্র নগরীতে পৌঁছে দেয়, যেন স্বর্গের একাংশ সত্যিই এখানেই অবস্থিত।


 

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha