হাওজা নিউজ এজেন্সি আশারক আল-আওসাত পত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে যে, ইয়াহিয়া সিনওয়ার গাজার দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনুস শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ ও বেড়ে ওঠেন। তাঁর পরিবার মূলত আল-মাজদাল শহরের অধিবাসী ছিল, যাদের ১৯৪৮ সালের নাকবা-পরবর্তী সময়ে উচ্ছেদ করে শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়। শৈশব ও কৈশোরে সিনওয়ার শিবিরের স্থানীয় স্কুলগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং পরে গাজা ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষা ও সাহিত্যে ডিগ্রি অর্জন করেন।
কারাগারের ভেতরেও নেতৃত্ব
কারাগারে থাকাকালীনও সিনওয়ার ইসরায়েলি জেলখানার ভেতরে হামাস বন্দিদের মধ্যে নিরাপত্তা ও সাংগঠনিক কার্যক্রম সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি দ্রুতই হামাস বন্দিদের স্বীকৃত নেতা ও কৌশলগত পরামর্শদাতা হয়ে ওঠেন।
ইসমাত মনসুর, যিনি ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত এক সাবেক ফিলিস্তিনি বন্দি এবং বহু বছর ইসরায়েলি কারাগারে ছিলেন, সিনওয়ারকে এভাবে বর্ণনা করেছেন, “তাঁর সঙ্গে কথা বললে মনে হয়, যেন এক সাধারণ, বিনয়ী ও ধর্মপরায়ণ মানুষের সঙ্গে কথা বলছি। তাঁর চরিত্রে ধর্মীয় নীতির ছাপ গভীরভাবে প্রোথিত ছিল—তিনি কখনও কোনো সম্পর্কে জড়াতেন না, যদি তা নীতিগত অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হতো।”
মনসুরের মতে, সিনওয়ার কখনও আপস বা আত্মসমর্পণের পক্ষে ছিলেন না। তিনি যে কোনো সমঝোতা বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে কেবল কৌশলগত প্রয়োজনীয়তা হিসেবে দেখতেন, নীতিগত অবস্থান নয়।
অন্যদিকে, আবদুল ফাত্তাহ দোলাহ, যিনি ফাতাহ আন্দোলনের সাবেক বন্দি এবং বহু বছর সিনওয়ারের সহবন্দি ছিলেন, জানান, “সিনওয়ার ছিলেন সামাজিক, সহানুভূতিশীল এবং এমন একজন মানুষ যার সঙ্গে সহজে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা যেত।”
আরেক সাবেক বন্দি, সালাহউদ্দিন ত্বালেব, যিনি বহু বছর সিনওয়ারের সঙ্গে একই সেলে ছিলেন এবং পরবর্তীতে একসঙ্গে মুক্তি পান, বলেন, “‘আবু ইব্রাহিম’ (সিনওয়ার)-এর বিনয়, তরুণদের সঙ্গে প্রাণবন্ত সম্পর্ক এবং গভীর মানবিক আচরণ তাঁকে সবার কাছে প্রিয় করে তুলেছিল। তবে তাঁর নিরাপত্তামুখী সতর্কতা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা তাঁকে অন্য হামাস নেতাদের থেকে স্পষ্টভাবে পৃথক করেছিল।”
কারাগারে “নিরাপত্তা-মনোবিকার” পর্ব
১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে হামাস এবং এর সামরিক শাখাগুলো পশ্চিম তীর ও গাজায় ভয়াবহ দমন-নিপীড়নের মুখে পড়ে। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা একে একে ইয়াহিয়া আয়াশ ও ইমাদ আকেল-এর মতো শীর্ষ কমান্ডারদের হত্যা করে, হাজার হাজার সদস্যকে গ্রেফতার করে এবং সংগঠনের অনেক সেল ভেঙে দেয়।
এই পরিস্থিতির প্রভাব এমনকি ইসরায়েলি কারাগারগুলোকেও নাড়িয়ে দেয়। ঠিক সেই সময় সিনওয়ার এমন এক মানসিক অবস্থায় প্রবেশ করেন, যাকে তাঁর সহবন্দিরা রসিকতার ছলে বলতেন “নিরাপত্তা-মনোবিকার”—অর্থাৎ নিরাপত্তা বিষয়ে অতিরিক্ত সতর্কতা, সন্দেহ এবং অতিমাত্রার শৃঙ্খলাবোধ। তবে অনেকের মতে, এই অতিসতর্কতা পরবর্তীতে তাঁকে এক অনন্য কৌশলবিদে রূপান্তরিত করে।
শালিত বন্দি-বিনিময় ও সিনওয়ারের ভূমিকা
১৯৯০-এর দশকের শুরুতে, যখন সিনওয়ার এখনো কারাগারে ছিলেন, হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জুদ্দিন আল-কাসসাম ব্রিগেডস গঠিত হয় এবং ইসরায়েলি সামরিক স্থাপনাগুলোতে ধারাবাহিক অভিযান শুরু করে।
কারাগারের ভেতর থেকেই সিনওয়ার কাসসাম ব্রিগেডের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং সংগঠনের দিকনির্দেশনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন।
২০১১ সালে মুক্তির পর তাঁর এসব সম্পর্ক আরও গভীর হয় এবং তাঁর জীবনের এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। গিলাদ শালিত বন্দি-বিনিময় চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর “আবু ইব্রাহিম” (সিনওয়ার) ও তাঁর সহযোদ্ধারা মুক্তি পান এবং নেতৃত্বের নতুন ধাপে প্রবেশ করেন।
তাঁর ছোট ভাই মোহাম্মদ সিনওয়ার, যিনি কাসসাম ব্রিগেডের শীর্ষ কমান্ডারদের একজন ছিলেন, গিলাদ শালিত বন্দি করার অভিযানে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন—যে বন্দিকে পরবর্তীতে ২০১১ সালের আলোচনার মাধ্যমে মুক্তি দেওয়া হয়।
কারাগারে থাকাকালীন সিনওয়ারের প্রভাব এতটাই গভীর ছিল যে ইসরায়েলি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সরাসরি কারাগারে এসে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেন এবং তাঁকে আলোচনার কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেন।
মৃত্যুর মুখে সিনওয়ার
বন্দি বিনিময় আলোচনার শেষ পর্যায়ে, যখন সমঝোতা প্রায় চূড়ান্ত, তখন সিনওয়ার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে যান—যা ইসরায়েলের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে বড় পরিবর্তন আনে।
দোলাহ বলেন, “সিনওয়ার অত্যন্ত কঠোর চরিত্রের মানুষ ছিলেন; তিনি কখনও স্বেচ্ছায় কারাগারের চিকিৎসাকেন্দ্রে যেতেন না।”
অবশেষে একদিন তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লে সহবন্দিরা জোর করে তাঁকে চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যান। তাঁর শারীরিক অবস্থা এতটাই গুরুতর ছিল যে তাঁকে দ্রুত বিরশেবা কারাগারের মেডিকেল ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়। পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠলে কারা কর্তৃপক্ষ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে পুরো সেকশন বন্ধ করে দেয়।
অভূতপূর্বভাবে—যা ফিলিস্তিনি বন্দিদের প্রতি ইসরায়েলের প্রচলিত উদাসীনতার সম্পূর্ণ বিপরীত—একটি হেলিকপ্টার কারাগারের ভেতরে নেমে আসে এবং তাঁকে অস্ত্রোপচারের জন্য দ্রুত সোরোকা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
চিকিৎসকরা তাঁর মস্তিষ্কে একটি সৌম্য টিউমার শনাক্ত করে তা অপসারণ করেন। এই জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচার প্রায় তাঁর জীবন কেড়ে নিচ্ছিল।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের এই অস্বাভাবিক তৎপরতা দেখিয়ে দেয়, বন্দি বিনিময় আলোচনার শেষ মুহূর্তে সিনওয়ারের মৃত্যু ঘটলে সেটি ইসরায়েলের জন্য কী ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারত।
২০১১ সালের পর সিনওয়ার ও কাসসাম ব্রিগেডস
মুক্তির পর সিনওয়ার শুধু হামাসের নিরাপত্তা বিভাগ পুনর্গঠন করেননি, বরং সামরিক শাখা কাসসাম ব্রিগেডস-এর সঙ্গে সম্পর্কও আরও সুদৃঢ় করেন। ২০১২ সালে তিনি হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন এবং ব্রিগেডসের সঙ্গে সমন্বয় ও পরিকল্পনা তদারকির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অবশেষে ২০১৭ সালে তিনি গাজায় হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান পদে অধিষ্ঠিত হন—যা তাঁর দীর্ঘ সংগ্রাম ও নেতৃত্বের স্বীকৃতি বহন করে।
কারাগারে ‘আল-আকসা ঝড়’ অভিযানের পূর্বাভাস
দোলাহ বলেন, বন্দিদের মধ্যে দীর্ঘদিন একটি ধারণা প্রচলিত ছিল যে সিনওয়ার “একটি মহৎ মিশনের জন্য নির্বাচিত মানুষ”। বছরের পর বছর তাঁর বক্তৃতা, পরামর্শ এবং অনুপ্রেরণামূলক বার্তাগুলো সেই ধারণাকে আরও দৃঢ় করেছিল।
২০২৩ সালের ‘আল-আকসা ঝড়’ অভিযান এবং পরবর্তীতে ইসরায়েলের গণহত্যামূলক আগ্রাসনের পর, ইসরায়েল সিনওয়ারকে এই সংঘাতের কেন্দ্রীয় মস্তিষ্ক ও প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে—যিনি কারাগারের ভেতর থেকেই প্রতিরোধের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দিকনির্দেশনা রচনা করেছিলেন।
আপনার কমেন্ট