হাওজা নিউজ এজেন্সি: গাজার অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি আবারও বিশ্ব মনোযোগকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের মূল কারণ এবং মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্য ঘিরে চলমান লড়াইয়ের দিকে ফিরিয়ে এনেছে। যদিও এই অস্থায়ী বিরতি তাৎক্ষণিক রক্তপাত রোধ করেছে, তবুও এর স্থায়িত্ব, পুনর্গঠন এবং দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে— যা বর্তমানে আঞ্চলিক আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে, ইরানি গণমাধ্যম মেহর নিউজ এজেন্সিকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে আতওয়ান ইসরায়েলের উদ্দেশ্য, যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এবং গাজার ভবিষ্যৎ বিষয়ে তাঁর বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। তিনি এই যুদ্ধবিরতিকে “অত্যন্ত নাজুক” বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন যে, ইসরায়েলের চুক্তিভঙ্গের ইতিহাস বিবেচনায় কোনো স্থায়ী শান্তির আশা করা যায় না।
আতওয়ানের বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দেয়, ইসরায়েলের নীতি কেবল রাজনীতি নয়, অর্থনীতি ও ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষারও প্রতিফলন— যেখানে “গ্রেটার ইসরায়েল” প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ও গাজার ধ্বংসযজ্ঞ একই প্রক্রিয়ার দুটি দিক।
মেহর নিউজ এজেন্সি’র সঙ্গে আবদেল বারি আতওয়ানের সাক্ষাৎকারের মূল অংশ:
১. আপনার মতে, বর্তমান যুদ্ধবিরতি কতটা টেকসই?ইসরায়েলের অতীত আচরণের আলোকে, বন্দি বিনিময়ের পর পুনরায় হামলার সম্ভাবনা কি রয়েছে?
আমি মনে করি, এই যুদ্ধবিরতি অত্যন্ত ভঙ্গুর, কারণ ইসরায়েল কখনোই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এর আগে বহুবার যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময়ের চুক্তি হয়েছে, কিন্তু কোনোটিই টেকেনি। লেবাননের উদাহরণ দেখুন— সেখানে আট মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ইসরায়েল ৫,০০০ বারেরও বেশি যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করেছে; প্রায় প্রতিদিনই তারা লেবাননে হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা করছে।
গাজার ক্ষেত্রেও একই অভিজ্ঞতা পুনরাবৃত্তি হতে পারে। যুদ্ধবিরতির পরও আজ গাজায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত নয়জন নিহত হয়েছেন। এরা কখনোই কথা রাখে না— লেবানন, ইয়েমেন, গাজা বা পশ্চিম তীর— কোথাও না। তাই আমি একেবারেই আশাবাদী নই।
২. গাজা পুনর্গঠনের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী? এবং কারা এই প্রক্রিয়ায় মুখ্য ভূমিকা নেবে বলে আপনি মনে করেন?
গাজার পুনর্গঠন হবে অত্যন্ত জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রক্রিয়া, কারণ বাস্তবে গাজা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরায়েল প্রায় ৯৫ শতাংশ বাড়িঘর ও ভবন ধ্বংস করেছে। দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষ আজ গৃহহীন।
এখন প্রশ্ন হলো— ইসরায়েল কি এই পুনর্গঠনকে অনুমতি দেবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন— এই বিপুল ব্যয় বহন করবে কে?
পরিস্থিতি একেবারেই করুণ। ইসরায়েল ধ্বংস করেছে, অথচ আরব দেশগুলোকে বলছে— তোমরাই পুনর্গঠনের খরচ দাও, যা সাতশো বিলিয়ন ডলারেরও বেশি হতে পারে। সুতরাং এখনই পুনর্গঠনের কথা বলা অবাস্তব। আমরা এখনও যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায়ে আছি। আমি বিশ্বাস করি, ইসরায়েল আবারও এই চুক্তি ভঙ্গ করবে এবং গাজা পুনর্দখল করবে— এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো— ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থনেই এসব করছে। ওয়াশিংটন ইসরায়েলকে গাজা ধ্বংসের “সবুজ সংকেত” দিয়েছে। ফলে আমরা গণহত্যা ও অনাহারের যুদ্ধ দেখছি। যতদিন আমেরিকা ইসরায়েলের পক্ষে থাকবে এবং তাদের গণহত্যা ও নৈতিক অবরোধকে সমর্থন করবে, ততদিন “পুনর্গঠন” কেবল একটি ফাঁপা শব্দ হিসেবেই থাকবে।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো— গাজার মানুষকে বাঁচানো। তাদের গণহত্যা, ধ্বংস ও অনাহার থেকে রক্ষা করা এবং মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর নিশ্চয়তা দেওয়া। মানুষ সেখানে প্রকৃত অর্থেই অনাহারে মৃত্যুর মুখে। তাই প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত— জীবন রক্ষা; তারপরই পুনর্গঠনের আলোচনা হতে পারে।
৩. সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতি বিষয়ে যে বৈশ্বিক সাড়া দেখা যাচ্ছে, তা গাজা ইস্যুর রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলছে বলে আপনি মনে করেন? আন্তর্জাতিক চাপ কি সত্যিই ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে?
এই পর্যায়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখা। দুই রাষ্ট্র সমাধান বা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আলোচনা এখন বাস্তবে বন্ধ হয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যে এই তথাকথিত শান্তি প্রক্রিয়ার পৃষ্ঠপোষক, তারা নিজেরাই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয় না। ট্রাম্প বারবার বলেছেন, তিনি কোনো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র মেনে নেবেন না এবং স্থায়ী সমাধান বা ন্যায়সঙ্গত শান্তির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
অবশ্যই, ফিলিস্তিনিরা তাদের নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্র চায়— কেবল পশ্চিম তীর ও গাজায় নয়, পুরো ফিলিস্তিনেই। কিন্তু সমস্যা হলো— ইসরায়েল শুধু ১৯৪৮ সালে দখল করা ভূখণ্ডেই সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না; তারা “গ্রেটার ইসরায়েল” প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ফিলিস্তিনের সমগ্র ভূখণ্ডের পাশাপাশি সিরিয়া, লেবানন, সৌদি আরবের অংশবিশেষ, ইরাক ও মিশরের কিছু অংশ দখল করতে চায়।
অর্থাৎ ইসরায়েলের লক্ষ্য হলো পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে পুনর্গঠন করা, নিজেদের আধিপত্যে আনা। তারা ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক অবকাঠামো ধ্বংসেরও চেষ্টা করছে। সুতরাং আমাদের এই বিষয়গুলো নিয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমেরিকা ও ইসরায়েল শান্তি চায় না; তারা ধ্বংসে দক্ষ, গঠনমূলক কাজে নয়। তারা নিষেধাজ্ঞা ও অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে ইরান, লেবানন, সিরিয়া, মিশরসহ সমগ্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে। আমাদের তাই ইসরায়েলের “গ্রেটার ইসরায়েল” পরিকল্পনার বিরুদ্ধে অত্যন্ত সতর্ক ও প্রস্তুত থাকতে হবে।
৪. যুদ্ধশেষে কি ইসরায়েলের নেতারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক জবাবদিহির মুখোমুখি হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ইসরায়েলি নেতাদের মূল লক্ষ্য হলো— সমস্ত ফিলিস্তিনিকে নিশ্চিহ্ন করা। ট্রাম্প নিজেই বলেছেন, তারা গাজায় একটি “মিডল ইস্ট রিভিয়েরা” তৈরি করতে চায়। গাজা অঞ্চলটি প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলসমৃদ্ধ, এবং ইসরায়েল-আমেরিকার স্বপ্ন হলো এখান থেকে শত শত বিলিয়ন ডলার আয় করা। এজন্য তারা ধীরে ধীরে গাজার অধিবাসীদের উচ্ছেদ করতে চায়।
তারা পরিকল্পনাটি ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করছে। এখন বলছে— যুদ্ধবিরতি হয়েছে; এরপর অজুহাত তৈরি করে সেই চুক্তি ভঙ্গ করবে এবং আন্তর্জাতিক সমাজের চাপ ভাঙার পথ খুঁজবে।
ট্রাম্প আসলে ইসরায়েলের পাশাপাশি নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থও দেখছেন। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি গাজাকে একটি লাভজনক বাণিজ্যিক প্রকল্পে রূপান্তর করতে চান। তাই ফিলিস্তিনি জনগণকে উচ্ছেদ করে “রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য” গড়াই তাদের লক্ষ্য। এটি আরব বিশ্বের সম্পদ লুণ্ঠন এবং গাজার জনগণের অস্তিত্ব বিলোপের এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্র।
সমাপনী মন্তব্য
আমি বিশ্বাস করি, মধ্যপ্রাচ্য এখনো যুদ্ধের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। যতদিন বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় থাকবেন, শান্তির কোনো সম্ভাবনা নেই— তিনি যুদ্ধের প্রেসিডেন্ট, শান্তির নয়।
তিনি ইসরায়েলকে আরও শক্তিশালী করতে এসেছেন— রাজনৈতিকভাবেও, সামরিকভাবেও। তিনি ইতোমধ্যে ইসরায়েলকে ২৬ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছেন এবং উন্নত অস্ত্র বিক্রির সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন— যার অর্থ হলো, আরও যুদ্ধ আসছে।
এই পুরো পরিকল্পনা ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হচ্ছে। তাই আমাদের অত্যন্ত সজাগ ও প্রস্তুত থাকতে হবে। যখনই ইসরায়েল ও আমেরিকা উপলব্ধি করবে যে, তাদের মোকাবিলায় মধ্যপ্রাচ্যে একটি শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে— তখনই তারা আলোচনার টেবিলে ফিরতে বাধ্য হবে। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত তারা জানে যে, তাদের প্রতিহত করার মতো শক্তি নেই, ততদিন এই অঞ্চল অস্থিতিশীলই থাকবে— হয়তো দশকজুড়ে, এমনকি শতাব্দীব্যাপী।
আপনার কমেন্ট