হাওজা নিউজ এজেন্সি: আমরা এখন এমন এক সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, যা বিশেষজ্ঞরা “প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগের যুগ” বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ যুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী উপাদান হলো— কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। প্রতিদিন আমাদের চোখে পড়া সংবাদ, ছবি, ভিডিও ও বিশ্লেষণের অনেকটাই এখন তৈরি হয় মানুষের চিন্তা ও মেশিনের অ্যালগরিদমিক প্রক্রিয়ার সম্মিলনে।
এমন বাস্তবতায় এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে আসে:
আমরা কাকে বিশ্বাস করব? মানুষকে, মেশিনকে— না কি উভয়ের তৈরি যৌথ বাস্তবতাকে? এই প্রশ্নের উত্তরই আমাদের নিয়ে যায় নতুন এক ধারণার দিকে— “বিশ্বাসের সাক্ষরতা” (Trust Literacy)।
“বিশ্বাসের সাক্ষরতা” — নতুন যুগের প্রয়োজনীয় দক্ষতা
ড. মাসুমা নাসিরি, মিডিয়া সাক্ষরতা বিষয়ে শিক্ষক ও গবেষক, বলেন—“আজকের দিনে আমাদের প্রয়োজন এমন এক দক্ষতা, যা শেখাবে কীভাবে প্রযুক্তি-নির্ভর এই দুনিয়ায় নিজের আস্থা পরিচালনা করতে হয়। মানবীয় ও যান্ত্রিক বার্তার সীমারেখা যখন মুছে যাচ্ছে, তখন এই দক্ষতা শুধু বিকল্প নয়; বরং চিন্তাগত অস্তিত্ব রক্ষার শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “‘বিশ্বাসের সাক্ষরতা’ আমাদের শেখায়— কাকে, কখন, কীভাবে এবং কেন বিশ্বাস করতে হবে। এটি এমন এক বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা, যা আমাদের অন্ধ বিশ্বাস ও অযৌক্তিক সন্দেহ— উভয়ই থেকে রক্ষা করে।”
তথ্য যাচাই ও সচেতন সন্দেহের গুরুত্ব
ড. নাসিরি মনে করিয়ে দেন, “মিডিয়া সাক্ষরতা আমাদের শিখিয়েছে— তথ্যের উৎস যাচাই করতে, ভুয়া সংবাদ চেনার কৌশল জানতে এবং মিডিয়ার প্রভাব থেকে সুরক্ষিত থাকতে। কিন্তু আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে মেশিন তৈরি টেক্সট, ছবি ও ভিডিও— এতটাই বাস্তবমুখী যে, সত্য-মিথ্যা পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়েছে।”
তাঁর মতে, “এখন কেবল তথ্য যাচাই নয়, বরং বিশ্বাস যাচাইও সমান জরুরি। আমাদের জানতে হবে— আমরা কেন কোনো বার্তা বিশ্বাস করছি, এবং সেটি কাদের দ্বারা কী উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছে।
বিশ্বাসের সাক্ষরতা গড়ে তোলার উপায়
ড. নাসিরি বলেন, “প্রশ্নটা হলো— কীভাবে এই বিশ্বাসের সাক্ষরতা তৈরি ও শক্তিশালী করা যায়?
এই প্রশ্নের উত্তরই আমাদেরকে প্রচলিত মিডিয়া সাক্ষরতা থেকে আরও গভীর এক চেতনার দিকে নিয়ে যায়। বিশ্বাসের সাক্ষরতা মানে হলো— জটিল যোগাযোগের পরিবেশে বিশ্বাসকে বোঝা, মূল্যায়ন করা ও পুনর্গঠন করার দক্ষতা।”
এই দক্ষতা বিকাশের ধাপ চারটি: →সচেতনতা →বিশ্লেষণ→ অভিজ্ঞতা →নৈতিক দায়বদ্ধতা।
প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান ও সচেতনতা
ড. নাসিরি বলেন, “আস্থা কখনোই অজ্ঞতার ওপর দাঁড়ায় না। তাই ব্যবহারকারীকে জানতে হবে— প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে, অ্যালগরিদম কীভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, তথ্যের বায়াস বা পক্ষপাত কীভাবে সৃষ্টি হয়। যেভাবে একসময় পড়া ও লেখা মৌলিক শিক্ষা ছিল, আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কিত জ্ঞানও প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক সাক্ষরতার অংশ হওয়া উচিত।”
বহুস্তরীয় যাচাইয়ের দক্ষতা (Multi-level Fact-Checking)
তিনি ব্যাখ্যা করেন, “আস্থা তখনই দৃঢ় হয়, যখন মানুষ নিজেই তথ্য যাচাই করতে পারে। এজন্য তিন স্তরের বিশ্লেষণ জরুরি—
প্রথম স্তর: তথ্যের উৎস ও সময় যাচাই।
দ্বিতীয় স্তর: বার্তার বর্ণনা বা ‘ন্যারেটিভ’ বিশ্লেষণ— তথ্যপ্রেরকের উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা।
তৃতীয় স্তর: অ্যালগরিদমিক বিশ্লেষণ— কেন এই বার্তাটি আমাদের সামনে এসেছে, কোন তথ্যগুলো গোপন রাখা হয়েছে তা অনুধাবন করা।”
তিনি যোগ করেন, “এই তিন স্তরের বিশ্লেষণ আমাদের শেখায় কেবল ‘কি’ সত্য তা নয়, বরং ‘কেন’ আমাদের সামনে সেই সত্যটি তুলে ধরা হয়েছে।”
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা
ড. নাসিরি বলেন, “বিশ্বাসের সাক্ষরতা কেবল ব্যক্তিগত দক্ষতা নয়; এটি একটি সামাজিক দায়িত্বও বটে। মিডিয়া, সাংবাদিক ও কনটেন্ট নির্মাতাদের উচিত— তাঁদের প্রযোজনার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ রাখা। দর্শকদের জানাতে হবে, কনটেন্টে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহৃত হয়েছে কি না, তথ্যের উৎস কোথায়, এবং কোনো সীমাবদ্ধতা বা পক্ষপাত রয়েছে কি না।”
তিনি বলেন, “যখন প্রযোজক সৎ ও জবাবদিহি করে কাজ করেন, তখন দর্শকও কনটেন্টের চেহারার ভিত্তিতে নয়— বরং প্রযোজকের স্বচ্ছ আচরণের ওপর আস্থা রাখতে শেখে।”
সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ
তিনি বলেন, “বিশ্বাসের সাক্ষরতা মানে এই নয় যে সবকিছু সন্দেহ করতে হবে। বরং এটি শেখায়— ‘গঠনমূলক সন্দেহ’ ও ‘ধ্বংসাত্মক অবিশ্বাস’-এর পার্থক্য বুঝতে। যিনি বিশ্বাসের সাক্ষরতা অর্জন করেছেন, তিনি অন্ধভাবে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করেন না; বরং প্রশ্ন করেন, তুলনা করেন, এবং যুক্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত নেন। এমন দৃষ্টিভঙ্গি আসলে আস্থাকে দুর্বল করে না— বরং আরও গভীর ও টেকসই করে।”
নৈতিকতা ও দায়বোধ
“বিশ্বাস তখনই টিকে থাকে, যখন তা নৈতিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়,” বলেন নাসিরি। তাঁর মতে—“তথ্য প্রচারে সততা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি সম্মান এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা— এগুলোই বিশ্বাসের স্থায়িত্বের ভিত্তি। AI ডেটা বিশ্লেষণ করতে পারে, কিন্তু নৈতিক মূল্যবোধের স্থান নির্ধারণ করতে পারে কেবল মানুষই।”
অ্যালগরিদম: নীরব কিন্তু প্রভাবশালী কাহিনিকার
ড. নাসিরি সতর্ক করে বলেন, “অ্যালগরিদম কেবল তথ্য সাজানোর টুল নয়; তারা বাস্তবতাকে গড়ে তোলে। কোন বিষয়টি আমাদের সামনে আসবে আর কোনটি আড়াল থাকবে— সেটি নির্ধারণ করে এই অ্যালগরিদমগুলোই। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর অন্ধ বিশ্বাস যেমন বিপজ্জনক, তেমনি সম্পূর্ণ অবিশ্বাসও ক্ষতিকর। প্রতিটি ডিজিটাল কাহিনি আসলে মানবীয় সিদ্ধান্ত, প্রযুক্তিগত সীমা ও অ্যালগরিদমিক উদ্দেশ্যের মিশ্রণ।”
শিক্ষা ও মিডিয়ার যৌথ ভূমিকা
তিনি বলেন, “যেভাবে মিডিয়া সাক্ষরতা আমাদের শেখায় কীভাবে বার্তাগুলো প্রশ্ন করতে হয়, বিশ্বাসের সাক্ষরতা আমাদের শেখায় কীভাবে সচেতনভাবে বিশ্বাস করতে হয়। শিক্ষা ও মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে—
যেমন: স্বচ্ছ অ্যালগরিদমের শিক্ষা, উৎস শনাক্তকরণ, ডিজিটাল নৈতিকতা, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব বোঝা।”
বিশ্বাস— আর কেবল অনুভূতি নয়, এক নৈতিক দক্ষতা
ড. নাসিরি তাঁর বক্তব্যের শেষে বলেন, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে বিশ্বাস আর শুধুই অনুভূতি নয়; এটি এক জ্ঞানভিত্তিক, সামাজিক ও নৈতিক দক্ষতা।
AI সত্যকে পুনর্গঠন করতে পারে, কিন্তু অর্থের রক্ষক এখনো মানুষই। আজ ‘আমরা কাকে বিশ্বাস করব?’— এই প্রশ্নের সরল উত্তর নেই। তবু নিশ্চিতভাবে বলা যায় বিশ্বাসের সাক্ষরতা-ই আমাদের পথ দেখাবে এমন এক ভবিষ্যতের দিকে, যেখানে মানুষ প্রযুক্তির দাস নয়, বরং সচেতন সহযাত্রী।”
আপনার কমেন্ট