বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫ - ০৮:৩১
ধৈর্য ও সংযমের মাধ্যমে কীভাবে অফুরন্ত আত্মিক সম্পদ লাভ সম্ভব?

ইমাম আলী (আ.)'র দৃষ্টিতে প্রকৃত সম্পদ হচ্ছে “কনাআত” বা পরিমিতিবোধ। এটি শুধু বাহ্যিক জীবনেই নয়, আত্মিক শান্তি ও সম্মানেরও প্রধান চাবিকাঠি। না-ফুরানো এ সম্পদ শুধু অর্থ বা সামগ্রীতে নয়, বরং আত্মার তৃপ্তি ও ব্যক্তিত্বের স্বকীয়তায় নিহিত।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: আমিরুল মু'মিনিন ইমাম আলী (আ.) নাহজুল বালাগাতে কনাআত তথা সংযম সম্পর্কে গভীর ইঙ্গিত করেছেন।

সংযমই অফুরন্ত ধন: ইমাম আলী (আ.)-এর দৃষ্টিতে কনাআতের মূল্য
নাহজুল বালাগা, হিকমা ৫৭-তে আমিরুল মু’মিনিন ইমাম আলী (আ.) বলেন,
«القَناعَةُ مالٌ لا یَنفَدُ»
অর্থাৎ: “সংযম এমন এক সম্পদ, যা কখনও ফুরিয়ে যায় না।”

এই হিকমার ব্যাখ্যা: ইমাম আলী (আ.)-এর এই সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর বাণীতে ‘কনাআত’ বা পরিমিতিবোধের মর্যাদা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কনাআত এমন একটি অভ্যন্তরীণ গুণ, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি প্রয়োজনীয় জিনিসেই তুষ্ট থাকে এবং বাহ্যিক জাঁকজমক বা অতিরিক্ত ভোগ-বিলাসে নিজেকে জড়ায় না।

এই মানসিকতা মানুষকে অভ্যন্তরীণভাবে ধনী করে তোলে। সে কারো কাছে হাত পাতে না, নিজের আত্মসম্মান রক্ষা করে এবং অনর্থক ব্যস্ততা ও নিষিদ্ধ পথে পা না বাড়িয়ে জীবনে সম্মান ও প্রশান্তির সঙ্গে চলতে পারে।

ইমাম আলী (আ.)-এর অন্যান্য বাণীতে কনাআত:
হিকমা ৪৪-তে ইমাম বলেন,
طُوبَی لِمَنْ ذَکَرَ الْمَعَادَ وَعَمِلَ لِلْحِسَابِ وَقَنِعَ بِالْکَفَافِ
“ধন্য সেই ব্যক্তি, যে আখেরাতকে স্মরণ রাখে, হিসাবের দিনের জন্য আমল করে এবং প্রয়োজনমাফিক জীবনে তুষ্ট থাকে।”

খুতবা ১৯২-তে নবীদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ইমাম উল্লেখ করেন,
مَعَ قَنَاعَة تَمْلاَُ الْقُلُوبَ وَالْعُیُونَ غِنًی
“তাদের মধ্যে এমন সংযম ছিল, যা অন্তর ও চোখকে পরিপূর্ণ করে দিত।”

বিহারুল আনওয়ার-এ ইমাম আলী (আ.)-এর একটি বাণী,
طَلَبْتُ الْغِنَی فَمَا وَجَدْتُ إِلاَّ بِالْقَنَاعَةِ عَلَیْکُمْ بِالْقَنَاعَةِ تَسْتَغْنُوا
“আমি ধন-সম্পদ অনুসন্ধান করেছিলাম, কিন্তু তা কেবল সংযমে পেয়েছি। অতএব সংযম অবলম্বন করো, তাতে সত্যিকারের সম্পদ অর্জিত হবে।”

এমনকি এ বাণী নবী করিম (সা.) থেকেও বর্ণিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন সাইয়্যেদ রযী। এবং আহলে সুন্নাতের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ কানজুল উম্মাল-এও এটি উল্লেখ রয়েছে।

আধুনিক সমাজে কনাআতের তাৎপর্য:
বেশিরভাগ মানুষের জীবনের অসন্তুষ্টির মূল কারণ হচ্ছে দারিদ্র্য নয়, বরং চাহিদার সীমাহীনতা। আমাদের চারপাশে অনেকেই আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়েও অতৃপ্ত—এটা কনাআতের অভাবেই। যদি মানুষ প্রয়োজনমাফিক জীবনকে গ্রহণ করতে শেখে, তাহলে পারিবারিক, সামাজিক এমনকি অপরাধ প্রবণতার অনেক সমস্যারও সমাধান হবে।

একটি দার্শনিক দৃষ্টান্ত:
ইবনে আবিল হাদীদ 'সুকরাত'-এর (সক্রেটিস) একটি ঘটনা উল্লেখ করেন: এক ব্যক্তি তাকে মাঠের সবজি খেতে দেখে বলেছিল, “যদি তুমি রাজাকে খেদমত করতে, তবে এসব খেতে হতো না।”

সক্রেটিস জবাব দেন, “তুমি যদি এসব খেতে অভ্যস্ত হতে, তাহলে রাজাকে খেদমত করতে হতো না।”

একটি কবিতার পঙ্‌ক্তি: “গৌরবের ধন আর সংযমের ধন – এ দুটো ধন এমন, যা রাজাদের জন্যও তরবারির জোরে অর্জনযোগ্য নয়!

ইমাম আলী (আ.)-এর এই শিক্ষাগুলো প্রমাণ করে, সত্যিকারের সম্পদ বাহ্যিক বস্তু নয়, বরং সংযম ও আত্মতুষ্টি। এই গুণ অর্জন করলেই একজন ব্যক্তি হয়ে ওঠে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন, মর্যাদাসম্পন্ন ও আত্মিকভাবে সমৃদ্ধ।

তথ্যসূত্র:
১.  নাহজুল বালাগা – হিকমা (নীতি-বাণী) ৫৭, ৪৪ এবং খুতবা (ভাষণ) ১৯২

২. বিহারুল আনওয়ার – খণ্ড ৬৬, পৃষ্ঠা ৩৯৯, হাদীস ৯১

৩. কানযুল উম্মাল – খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৩৮৯, হাদীস ৭০৮০

৪. তুহাফুল উকূল – পৃষ্ঠা ১০০

৫. তামাম নাহজুল বালাগা – পৃষ্ঠা ১৬২

৬. মাসাদিরে নাহজুল বালাগা (নাহজুল বালাগার উৎসসমূহ) – খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৫০

৭. পায়ামে ইমাম আমিরুল মু’মিনিন (আ.) – ইমাম আলী (আ.)-এর বাণীর ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha