শনিবার ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ - ১০:১৬
সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ: প্রতিরোধের ইতিহাস বদলে দেওয়া এক অমর নেতা

শহীদ সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ ছিলেন লেবাননের ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। দক্ষিণ লেবাননকে ২০০০ সালে ইসরাইলি দখল থেকে মুক্ত করা এবং ২০০৬ সালের ৩৩ দিনের যুদ্ধে ঐতিহাসিক বিজয়ের কারণে তিনি পরিচিত হন “প্রতিরোধের সাইয়্যেদ” নামে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: হিজবুল্লাহর তৃতীয় মহাসচিব ও প্রতিষ্ঠাতাদের একজন শহীদ হাসান নাসরুল্লাহ ১৯৯২ সাল থেকে ২০২৪ সালে শাহাদাত পর্যন্ত সংগঠনের নেতৃত্ব দেন। তাঁর নেতৃত্বে হিজবুল্লাহ একটি আঞ্চলিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। দক্ষিণ লেবাননের মুক্তি, বন্দিদের মুক্তি ও শহীদদের দেহাবশেষ ফেরত আনা এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে একের পর এক বিজয় তাঁর নেতৃত্বকালেই সম্ভব হয়। এর ফলে তিনি আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী নেতাদের শীর্ষে অবস্থান করেন।

শহীদ হাসান নাসরুল্লাহ ১৯৬০ (বা ১৯৬২) সালের ৩১ আগস্ট বৈরুতের পূর্বাঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে লেবাননে, পরে নাজাফে ধর্মীয় পড়াশোনা করেন। বাথ পার্টির চাপের মুখে ইরাক থেকে ফিরে এসে ইরানে যান এবং কোমে ইসলামী বিপ্লব ও ইমাম খোমেনির চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হন। এ সময় তিনি ফারসি ভাষা শেখেন এবং ইমাম খোমেনির প্রতিনিধি হিসেবে লেবাননে দায়িত্ব পালন শুরু করেন।

নেতৃত্বের পথে যাত্রা
১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত শহীদ হাসান নাসরুল্লাহ আমল আন্দোলনের সদস্য ছিলেন। কিন্তু ১৯৮২ সালে বিপ্লবী আলেমদের সঙ্গে নিয়ে তিনি হিজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠা করেন। ইমাম মুসা সাদরের প্রচেষ্টায় লেবাননের শিয়াদের ক্ষমতায়ন শুরু হয়, যা শহীদ নাসরুল্লাহ ও তাঁর সঙ্গীদের নেতৃত্বে নতুন গতি পায়।

১৯৯২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সাইয়্যেদ আব্বাস মুসাভির শাহাদাতের পর নাসরুল্লাহ হিজবুল্লাহর মহাসচিব নির্বাচিত হন। ৩২ বছর নেতৃত্ব দেওয়ার সময় তিনি প্রতিরোধ অক্ষের নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখেন এবং সংগঠনকে শক্তিশালী করেন।

ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
দক্ষিণ লেবাননকে ২২ বছরের ইসরাইলি দখল থেকে মুক্ত করা এবং ২০০৬ সালের ৩৩ দিনের যুদ্ধে বিজয় এনে দেওয়ার কারণে নাসরুল্লাহ “প্রতিরোধের সাইয়্যেদ” উপাধি লাভ করেন। পশ্চিমা গণমাধ্যম এবং এমনকি ইসরাইলি বিশ্লেষকরাও তাঁকে আরব বিশ্বের সবচেয়ে সাহসী, জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

প্রতিরোধের অক্ষ ও আঞ্চলিক ভূমিকা
শহীদ হাসান নাসরুল্লাহ নিজেকে সবসময় ইসলামি বিপ্লবের নেতার সৈনিক হিসেবে পরিচয় দিতেন। ২০০৯ সালে তিনি হিজবুল্লাহর নতুন রাজনৈতিক দলিল ঘোষণা করে ইরানের ওয়ালায়াতুল ফকিহ নীতির প্রতি আনুগত্য পুনঃনিশ্চিত করেন। ১৯৮৬ সাল থেকেই আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক শুরু হয় এবং তিনি প্রায়ই ইরানি নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে শহীদ কাসেম সোলাইমানির সঙ্গে কৌশলগত বৈঠক করতেন। ফিলিস্তিনিদের সমর্থন থেকে শুরু করে সিরিয়ায় আইএসআইএল ও তাকফিরি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই পর্যন্ত প্রতিরোধ অক্ষকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল নির্ণায়ক।

শাহাদাত
২০২৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, গাজার প্রতিরোধযোদ্ধাদের সহায়তা করার সময়, জায়নিস্ট বাহিনী বৈরুতের দক্ষিণ উপশহরে বিমান হামলা চালায় এবং নাসরুল্লাহ শাহাদাত বরণ করেন। ইসরাইলি গণমাধ্যম জানায়, এই হামলায় ৮০ টনেরও বেশি বাংকার-বাস্টার বোমা ব্যবহার করা হয়। লেবাননের সরকার ও সেনাবাহিনী আগের মতোই নিরুত্তাপ প্রতিক্রিয়া দেখালেও নাসরুল্লাহকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয়। শত সহস্র মানুষ এবং বিশ্বের ৭৯টি দেশের প্রতিনিধিদল তাঁর জানাজায় অংশ নেয়।

ইসলামি বিপ্লবের নেতা তাঁর শাহাদাতের পর এক বার্তায় তাঁকে “মহান সংগ্রামী ও প্রতিরোধ আন্দোলনের অগ্রদূত” হিসেবে বর্ণনা করেন।

আজ তাঁর শাহাদাতবার্ষিকীতে নাসরুল্লাহ শুধু লেবাননেই নয়, সমগ্র ইসলামি বিশ্বে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে স্মরণীয়। তিনি নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কণ্ঠস্বর ও জাতির মর্যাদার পতাকাবাহী, যিনি নিজের রক্ত দিয়ে আঞ্চলিক সমীকরণ পাল্টে দিয়েছেন। তাঁর শাহাদাত কোনো সমাপ্তি নয়; বরং এটি প্রতিরোধের নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যা ইসলামি উম্মাহ তাঁর পথ ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
 

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha