শনিবার ১৮ অক্টোবর ২০২৫ - ২২:০৪
আল্লাহর রহমতের নিকটবর্তী হওয়ার পথ

মানবজীবনের সকল সুখ-সমৃদ্ধি, শান্তি ও মুক্তির মূল উৎস আল্লাহ তাআলার অসীম রহমত। আল্লাহর করুণা ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব যেমন অর্থহীন, তেমনি তাঁর রহমত ছাড়া আত্মা প্রশান্তি পেতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো—আল্লাহর রহমতের প্রকৃত নৈকট্য লাভ করা সম্ভব কীভাবে? কেন অনেক সময় মানুষ রহমতের প্রত্যাশা করেও বঞ্চিত হয়?

হাওজা নিউজ এজেন্সি: এই গভীর বিষয় নিয়েই ইসলামী নৈতিকতার খ্যাতনামা শিক্ষক আয়াতুল্লাহ আযিজুল্লাহ খোশওয়াক্ত(রহমতুল্লাহি আলাইহি) তাঁর এক বয়ানে আলোচনা করেছেন, যার সারমর্ম আজও প্রতিটি ঈমানদারের জন্য দিশারি স্বরূপ।

কুরআনের ঘোষণা
আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেছেন:
إِنَّ رَحْمَتَ اللَّهِ قَرِيبٌ مِنَ الْمُحْسِنِينَ
“নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত মুহসিনদের কাছাকাছি।” (সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত ৫৬)

এই আয়াতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহর রহমতের বিশেষ নৈকট্য অর্জন করে কেবল সেই ব্যক্তিরা, যারা “মুহসিন”—অর্থাৎ যারা সৎকর্মপরায়ণ, আল্লাহর আদেশ পালনকারী, এবং নৈতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ।

“মুহসিনিন” কারা?
আয়াতুল্লাহ খোশওয়াক্ত (রহ.) ব্যাখ্যা করেন যে, কুরআনে “মুহসিনিন” শব্দটি “মুততাকিন” (পরহেজগারদের) সমার্থক। “মুহসিন” সেই ব্যক্তি, যার কাজ কেবল বাহ্যিকভাবে সঠিক নয়, বরং অন্তরে সৌন্দর্য, আন্তরিকতা ও আল্লাহভীতি নিহিত থাকে।

তিনি বলেন, “মুহসিন সেই, যিনি এমন কাজ করেন যা ‘হাসান’—অর্থাৎ সুন্দর, সৎ ও ঈশ্বরসম্মত। তাঁর কোনো কাজ ‘কুবহ’—অর্থাৎ কদর্য, অন্যায় বা নিষিদ্ধ হয় না। অর্থাৎ, মুহসিন সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর নির্দেশমতো আমল করে; নিজের মনগড়া নয়, বরং আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী।”

আল্লাহ সর্বত্র, তবে নৈকট্যের পার্থক্য রয়েছে
নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা সর্বজ্ঞানী, সর্বশক্তিমান এবং সর্বত্র উপস্থিত। তবে আল্লাহর বিশেষ নৈকট্য ও সহায়তা শুধু তাঁদের জন্য বরাদ্দ, যাঁরা তাকওয়াবান, নাফরমানি থেকে বিরত, এবং আল্লাহর আদেশে আত্মসমর্পিত।

কুরআনে আল্লাহ বলেন:
وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ
“জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকিদের সঙ্গে আছেন।” (সূরা আত-তাওবা, আয়াত ৩৬)

এই আয়াতের আলোকে আয়াতুল্লাহ খোশওয়াক্ত বলেন, “আল্লাহর নৈকট্য কেবল জ্ঞানে নয়, বরং রহমত, তাওফিক, সাহায্য ও অনুগ্রহের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এই দান ও তাওফিক শুধুমাত্র তাদের জন্য, যারা গুনাহ থেকে বিরত থেকে আল্লাহর আনুগত্যে জীবন গড়ে।”

গুনাহ: রহমতের অন্তরায়
আয়াতুল্লাহ খোশওয়াক্ত (রহ.) সতর্ক করে বলেন, “যদি আমরা গুনাহ করি এবং তবুও আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশা রাখি, তবে এটি আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া কিছু নয়। কারণ রহমত সর্বত্র বিস্তৃত, কিন্তু গুনাহ সেই রহমতের প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে।”

আল্লাহর রহমত যেন সূর্যের আলো—যা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু পাপ যেন ঘন কালো মেঘ—যা সেই আলোকে ঢেকে দেয়। অতএব, রহমতের নিকট হতে চাইলে মেঘ সরাতে হবে, অর্থাৎ গুনাহ ত্যাগ করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, “যদি আমরা পাপ থেকে দূরে থাকি, আল্লাহ আমাদের প্রতি সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়ে যান; এমনকি নিজের প্রাণ থেকেও নিকটে, যেমন কুরআনে বলা হয়েছে:
‘وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ’
— আমরা মানুষের গলার শিরার চেয়েও তার নিকটে।” (সূরা ক্বাফ, আয়াত ১৬)

রহমতের পথ: তাকওয়া ও ইহসান
আল্লাহর রহমতের ছায়ায় আশ্রয় নিতে হলে মানুষকে দুটি মৌলিক গুণে নিজেদের সাজাতে হবে:
তাকওয়া (আল্লাহভীতি ও সংযম)— গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা ও নিষিদ্ধ বিষয় ত্যাগ করা।
ইহসান (সুন্দর ও সৎকর্ম)— আল্লাহর জন্য আমল করা, যেন আমরা তাঁকে দেখতে পাচ্ছি, অথবা অন্তত জানি যে তিনি আমাদের দেখছেন।

যে ব্যক্তি এই দুই গুণ অর্জন করে, সে কেবল রহমতের নিকটে নয়, বরং রহমতের ছায়াতলে নিরাপদ হয়ে যায়।

আয়াতুল্লাহ খোশওয়াক্ত (রহ.)-এর এই নৈতিক বাণী আজকের যুগেও অপরিসীম তাৎপর্য বহন করে। আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যখন বাহ্যিক প্রাচুর্য আছে, কিন্তু অন্তর শুকিয়ে গেছে। এই অন্তরের শুষ্কতাকে প্রশান্ত করতে হলে, আমাদের প্রয়োজন আল্লাহর রহমতের ছোঁয়া— আর সেই ছোঁয়া পাওয়া সম্ভব কেবল তাকওয়া, ইহসান ও গুনাহ পরিহারের মাধ্যমে।

আল্লাহর রহমত সীমাহীন, কিন্তু তার কাছে পৌঁছানোর জন্য আমাদের হৃদয়কে শুদ্ধ করা, আমলকে সুন্দর করা, এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে অবিচল থাকা আবশ্যক।

দোয়া
اللهم اجعلنا من المحسنين و المتقين، و قرّبنا برحمتك من فضلك العظيم.
“হে আল্লাহ! আমাদেরকে মুহসিন ও মুত্তাকিদের অন্তর্ভুক্ত করুন, এবং আপনার অসীম রহমতের নিকটে আমাদের পৌঁছে দিন।”

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha