মঙ্গলবার ৩ জুন ২০২৫ - ০০:৫২
কুরআন: নারীর প্রকৃত মর্যাদা জানার একমাত্র উৎস

আহলে বাইত (আ.)-এর দৃষ্টিতে হযরত হাওয়া (আ.) সেই একই মাটি থেকে সৃষ্টি হয়েছেন, যেখান থেকে আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। এভাবে পুরুষ ও নারীর সৃষ্টিতে কোনো পার্থক্য নেই।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: নারী, তার মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে বিভিন্ন বিদ্যা ও গবেষণায় ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু আমরা মুসলমানরা বিশ্বাস করি যে কুরআন সকল মানুষের ফিতরাত (প্রকৃতি)-এর উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এটি একমাত্র এমন উৎস যা নারীর প্রকৃত মূল্য ও মর্যাদাকে সম্পূর্ণরূপে উপস্থাপন করতে পারে এবং এ সংক্রান্ত সকল সন্দেহের জবাব দিতে সক্ষম। তাই আমরা কুরআনের আয়াতগুলো বিশ্লেষণ করে এই সন্দেহের উৎস খুঁজে বের করেছি এবং এর উত্তর কুরআন থেকেই পেয়েছি। 

কুরআনের আয়াতগুলো পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, নারী সম্পর্কে প্রায় ৪০০টি আয়াত রয়েছে। এসব আয়াতকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়: 

প্রথম শ্রেণী: যেসব আয়াতে নারী ও পুরুষের সমতা নির্দেশ করা হয়েছে। এগুলো নারী ও পুরুষ উভয়ের অস্তিত্বগত, মানবিক মূল্য এবং তাদের আমলের গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগুলো সাধারণভাবে সমস্ত মানুষকে সম্বোধন করে এবং এতে সৃষ্টির প্রথম পর্যায়ে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য বা বৈষম্য দেখা যায় না। 

প্রকৃতপক্ষে, এই আয়াতগুলো মানবিক ব্যক্তিত্বকে মূল বিবেচ্য বিষয় হিসেবে ধরে এবং নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য করে না। এই আয়াত সমূহ নির্দেশ করে যে, মূল্য ও মর্যাদা শুধুমাত্র কর্মের মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়। 

দ্বিতীয় শ্রেণী: যেসব আয়াতে নারী ও পুরুষের দৈহিক ও আত্মিক গঠন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এগুলো উভয় লিঙ্গের মধ্যে কিছু পার্থক্য উল্লেখ করে এবং বলে যে, এই গঠনগত ও দৈহিক পার্থক্যগুলো উভয়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব সৃষ্টি করে। ফলে তাদের অধিকারও ভিন্ন হবে। অর্থাৎ, গঠনগত পার্থক্য ভিন্ন দায়িত্ব আনে, আর ভিন্ন দায়িত্ব ভিন্ন অধিকার সৃষ্টি করে। 

প্রথম শ্রেণীর আয়াত, যেখানে উভয় লিঙ্গের সৃষ্টির মৌলিক সারাংশে সমতা ও সাদৃশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, তার মধ্যে সূরা নিসার প্রথম আয়াতটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই আয়াতে বলা হয়েছে: 
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا...
(হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে এক نفس (আদম) থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকেই তার জোড়া (হাওয়া) সৃষ্টি করেছেন...)

এই আয়াতটি ‘يَا أَيُّهَا النَّاسُ’ (হে মানুষ!) দিয়ে শুরু হয়েছে, যা উভয় লিঙ্গকে সম্বোধন করে। এখানে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তোমাদেরকে একই সত্তা থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তারপর বলেছেন: ‘وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا’ (এবং তার থেকেই তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন)। অর্থাৎ, হাওয়া (আ.)-কে আদম (আ.)-এর সৃষ্টির একই মাটি বা উপাদান থেকে তৈরি করা হয়েছে। 

এই আয়াতের ব্যাখ্যা নিয়ে একটি সাধারণ ভুল হলো ‘مِنْ’ (মিন) শব্দটিকে ‘مِنْ تَبْعِيضِيَّة’ (অংশবাচক) হিসেবে অনুবাদ করা। এতে একটি ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয় যে, নারীদেরকে পুরুষদের অস্তিত্বের একটি অংশ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এখানে ‘مِنْ’ হলো ‘مِنْ جِنْسِيَّة’ (জাতিবাচক), অর্থাৎ আদম (আ.)-এর সত্তার সমগোত্রীয়, তার অংশ নয়। 

উদাহরণস্বরূপ, আরবিতে বলা হয়: ‘هَذَا الْخَاتَمُ مِنَ الْفِضَّةِ’ (এই আংটি রূপা থেকে তৈরি), অর্থাৎ এটি রূপার গোত্রভুক্ত, রূপার একটি অংশ নয়। 

এভাবে, এই যুক্তি অনুসারে বলা যায় যে, আল্লাহ তাআলা আদম (আ.)-এর জোড়া (হাওয়া)কে একই মাটির গোত্র থেকে সৃষ্টি করেছেন, আদম (আ.)-এর দেহের কোনো অংশ থেকে নয়। 

ইমাম মুহাম্মদ বাকির (আ.)-এর ব্যাখ্যা: ‘তাফসীর আল-আয়াশী’ (১ম খণ্ড)-এ বর্ণিত হয়েছে যে, একদা আমর ইবনে আবি মাকদাম ইমাম বাকির (আ.)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন: ‘কিছু লোক বলে যে, আল্লাহ হাওয়াকে আদমের বাম পাঁজর থেকে সৃষ্টি করেছেন, এটি কি সত্য?’

ইমাম বাকির (আ.) উত্তরে বললেন, “এরা মিথ্যা বলছে! আল্লাহ কি এমন অক্ষম যে, তিনি হাওয়াকে আদমের পাঁজর ছাড়া অন্য কিছু থেকে সৃষ্টি করতে পারবেন না?”

সুতরাং, আহলে বাইত (আ.)-এর দৃষ্টিতে, হাওয়া (আ.)-কে সেই একই মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, যেখান থেকে আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। এভাবে, পুরুষ ও নারীর সৃষ্টিগত কোনো পার্থক্য নেই। 

অতএব, আমরা এভাবে উপসংহার টানতে পারি যে, নারী ও পুরুষ—যারা বাহ্যিকভাবে ভিন্ন, তারা যদি কুরআনের আয়াত এবং শব্দের সঠিক অনুবাদ সহকারে তাদের সৃষ্টির মূল উৎস সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করে, তাহলে তারা বুঝতে পারবে যে উভয়ই একই উৎস থেকে এসেছে। তারা আদম ও হাওয়া নামে বিকশিত হয়েছে, কিন্তু তাদের জীবন ও অস্তিত্বের মূল উপাদান একই। 

লিখেছেন: মারজিয়া সাদাত হাশেমি রা’দ

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha